দইয়ের আসল মূল্য কি?

এডমিন
0
দইয়ের আসল মূল্য কি? - #এম_ওয়াসিক_আলি

আজ সৌমিত্রের জন্মদিন, বাহান্ন বছর পার করে তিপান্নতে পা দিল।

জীবনে সে অনেক কিছুই হারিয়েছে, আর্মির এক দন্ডপ্রতাপ, নির্ভীক অফিসার থেকে আজ এক সাধারণ মানুষ। প্রায় দশ বছর হল সুমেধা নেই, আবির তখন খুব ছোট , ক্লাস এইটে পড়ে, মায়ের অন্তপ্রাণ ছিল। অকালে সুমেধা চলে যাওয়ার পর সৌমিত্রের আর চাকুরীতে মন লাগলো না, একমাত্র সন্তান আবির, তাকেই বা কে দেখবে? বড়দা - বৌদি অনেক জোরাজুরি করেছিলেন দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে, কিন্তু সুমেধাকে যে কথা দিয়েছিল, সে কিছুতেই খেলাপ করবে না। আবিরকে মনের মত মানুষ করবে আর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তার  পাশে থাকবে। চাকরি বাকরি ছেড়ে যা কিছু প্রাপ্য ছিল সেটাই সম্বল করে বাড়িতেই কর্পোরেট ব্যবসা শুরু করল। আর্মির পেশাদারিত্ব, পরিশ্রম ও ডিসিপ্লিনকে কাজে লাগিয়ে খুব শীঘ্রই ব্যবসাতে সাফল্য অর্জন করল।

আবির গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট  করার পর পড়াশুনায় ছেদ দিয়ে বাবার ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প নিল। অল্পদিনের মধ্যেই বাবা-ছেলে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে ব্যবসাটাকে খুব ভালো পর্যায়ে  নিয়ে গেল।

*******

মাস তিনেক আগেই একমাত্র পুত্রের বিয়ে মহা ধুমধামে, পরিচিত এক বন্ধুর কন্যার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে  "কেয়া", আবিরেরও খুব পছন্দ ছিল।

কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই সৌমিত্র বুঝতে পারল, বৌমার চিন্তা ভাবনা আধুনিক ও একটু অন্যধরণের, শশুড়ের প্রতি উদাসীন, হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেয় ছেলে-বৌমার সংসারে তিনি অবাঞ্ছিত। আবিরের কথা ভেবে সৌমিত্র মুখ বুজে সব সহ্য করতে লাগল। মা মরা ছেলেকে আর কষ্ট দিতে চায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসে কাটে, ব্যাপারটা আবিরও লক্ষ্য করেছে, সে পঁয়-পঁয় করে বোঝানোর চেষ্টা করে বাবা তুমি বটগাছের মতই শক্ত হয়ে পাশে থেকো আর আশীর্বাদ কর, এই বয়সে আর ছোটাছুটি, পরিশ্রম করতে হবে না। ছেলের কথা শুনে সৌমিত্র শুধু হাসে।

কেয়া এ বাড়িতে আসার পর আজই সৌমিত্রের প্রথম জন্মদিন। বিয়ের পর থেকেই সুমেধা এই বিশেষ দিনটিতে একটু ভালোমন্দ রান্নাবান্না করতো। প্রিয় খাসির মাংসের পর শেষ পাতে টকমিষ্টি দই, একরকমই অলিখিত নিয়ম ছিল।  দই সৌমিত্রের খুব পছন্দের।  সুমেধা দই বাড়িতেই বসাতো, বাড়ির সেই দইয়ের স্বাদ  সৌমিত্র কোনও দিনই ভুলতে পারে না। আবিরও বাবার মত সেই দই খেতে খুব পছন্দ করে।সুমেধা যাওয়ার পর সেই কাজটি আবির সযত্নে করে আসছে, অনেকটা মায়ের মতই । গতকাল রাতে খাবার খেতে খেতে সে বলল বাবা আগেভাগেই দই বসিয়ে দিয়েছি। সৌমিত্র শুধু হেসেছিল। 

একটা নতুন টেন্ডারের কাজে ব্যস্ততার জন্য লাঞ্চ করার জন্য বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে এসে দেখে বৌমা যথারীতি পূর্বপরিকল্পনা মাফিক রান্নাবান্না করেছে। খাওয়ার শেষে বাবা ও ছেলে দুজনেই দইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, কিন্তু রান্না ঘর থেকে কোনও হেলদোল, সাড়াশব্দ না পেয়ে  সৌমিত্র উঠে গেল। যথারীতি আধঘণ্টা খানেক বিশ্রামের পর, অফিসের রওনা দিল। 

বাবা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেয়া, এক বাটি দই সুন্দর করে সাজিয়ে আবিরের সামনে রাখল। আবির আশ্চর্য হয়ে কেয়ার দিকে তাকাল। আজ বাবার জন্মদিনে, বাবার পছন্দের দই তাকে না খাইয়ে, নিজে খাবে? নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল, বাবার সামনেই বা কি ভাবে দাঁড়াবে, সাত-পাঁচ ভাবতে লাগলো।

কেয়া বলল - তুমি খুব পছন্দ কর বলে বাবাকে না দিয়ে শুধু তোমার জন্য রেখেছি।সে ভাবল আবির নিশ্চিত খুব খুশি হবে।

আবির শান্তসুরে বলল, ঠিক আছে রেখে দাও, আর হ্যাঁ এক গ্লাস ফ্রিজের জল নিয়ে এসো। কেয়া জল আনতে চলে গেল, হাসিমুখে জলের গ্লাস আবিরের সামনে রেখে পাশে বসল। খালি বাটি দেখে বলল - এত তাড়াতাড়ি দই খেয়ে ফেলেছো? মনে মনে আরও খুশি হল।

আর এক বাটি মত আছে, একটু অপেক্ষা করো,এনে দিচ্ছি বলেই কেয়া উঠে দাঁড়াল।  

আবির বলল, না না আর খাবো না, পেট ভর্তি। বাকিটা তুমিই খেয়ে নাও। 

আবির অফিসে গিয়ে দেখে বাবা মুখ গুঁজে হিসেব-পত্তরে ব্যস্ত।

বাবা ! সৌমিত্র চোখ তুলে বলল, হ্যাঁ, কিছু বলবি?

আবিরের চাপা কষ্ট হচ্ছিল, বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু বাবাকে বুঝতে দিল না। শুধু বলল, টেন্ডারের কাগজপত্রগুলো দাও, বাকি ফর্মালিটি শেষ করি, আজকের মধ্যে ফাইনাল করে কাল সকালেই ট্রান্সপোর্ট এ দিতে হবে। বাবা বলল, ঠিক আছে এবং সব কাগজপত্র আবিরকে বুঝিয়ে দিলেন।

এই ঘটনার পর আবির খুব ডিস্টার্ব। সব কিছুই আগের মত চলতে লাগল, কিন্তু অজান্তেই সৌমিত্র কেমন যেন গুটিয়ে গেল। বাবা-ছেলের মাঝে নিঃশব্দে এক বিশাল প্রাচীর গড়ে উঠল। 

*****
অফিস থেকে বেরিয়ে আবির কোনও না কোনও বাহানা করে কোথাও চলে যায়, বাড়ি ফিরতে রাত হয়। কেয়া চিন্তিত আবিরের এই আকস্মিক পরিবর্তনে, কি জানি কোনও কুসঙ্গে জড়াল কিনা?

দু-একবার সৌমিত্র ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু আবিরের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেল না। সেও ছেলের পরিবর্তনে চিন্তিত। 

দিন পনেরো পর অফিস ঠিক বেরোনোর আগে আবির বাবাকে বলল, বাবা আজ কোর্টে যেতে হবে?

সৌমিত্র বলল - কোর্টে কেন? অফিসে কোনও গোলমাল হয়েছে নাকি? 

আবির স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আজ তোমার বিয়ে? সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, নতুন মায়েরও সন্ধান পাওয়া গেছে!

বিয়ের কোথা শুনে কেয়ার রীতিমতো বেহুঁশ হওয়ার মত অবস্থা? মাথা বন-বন করে ঘুরছে। আবিরের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, না ভুতে ধরেছে!! নতুন করে কেন বাড়িতে হ্যাপা টেনে আনতে চাইছে?

কেয়া ভাবতে লাগল-বাড়িতে শাশুড়ি এলে তো সব শেষ। তার একচ্ছত্র আধিপত্যে লাল দাঁড়ি পড়বে। সে তো বেশ সুখেই আছে!! বন্ধু বান্ধবের কি ভাবে মুখ দেখাবে, সকলে মুখ টিপে হাসবে। সবাই ভাববে কেয়ার জন্যই শশুর বিয়ে করছেন, আরও অনেক চিন্তা ভাবনা তার মাথাই এল...।

কেয়া বলল, বাবা এই বয়সে বিয়ে করবেন? কেন তাঁর কি আদরযত্নে কোনও রকমের ত্রুটি রেখেছি নাকি? কিছু বলার থাকলে আমাকে বলো। 

সৌমিত্র বলল, দেখ আবির বৌমা ঠিকই বলছে, তোরা এত আদরযত্ন করিস আর আমার জীবনের সবকিছুই তো তোরা।

না বাবা, তুমি চুপচাপ আমার সাথে চলো, আমি সব ঠিক করে ফেলেছি।

বাবা বললেন, কি আজেবাজে বকছিস? আমি কেন আবার বিয়ে করতে যাবো? আমার বিয়ের পিঁড়িতে বসার কোনও ইচ্ছে নেই।অফিস চল, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে।

না বাবা, আমি মোটেও মজা করছি না। আমি সিরিয়াস, কিছুক্ষণের মধ্যেই দু চার জন বন্ধুবান্ধব আসবে, কেয়ার বাবাকেও ডেকেছি। উনারও সম্মতি আছে।

কেয়া মনে মনে ভাবল - বাবার সম্মতি? কেয়ার বুক আরোও ধুকপুক  করতে লাগল। 

দেখ আবির, তোর মাথায় কি চলছে আমি জানি না, কিন্তু স্পষ্ট করে বলছি, পাগলামি করিস না,  "না তোর মায়ের দরকার আছে না আমার বউ চাই! তুই পাগলামি ছাড়!!

না বাবা , আমিও মা চাই না !

তবে কেন খ্যাপামি করছিল কেন আর কেনই বা ভুলভাল বকছিস ?

আমি কিছুই করছি না , শুধু "তোমার জন্য দইয়ের ব্যবস্থা করছি"।

সৌমিত্র হতবাক, এই সামান্য ব্যাপারটাকে এতো সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে তা কল্পনার বাইরে।

সৌমিত্র  কিছু বলার আগেই, আবির বলল - আর হ্যাঁ, আমি আর একসঙ্গে এই বাড়িতে থাকতে পারবো না। শশুর বাড়িতে উঠবো ঠিক করেছি, ও বাড়িও খালি পড়ে আছে, কালকেই কেয়াকে নিয়ে ওখানে শিফট করবো। আরও বলল, আমি এর পর তোমার অফিসে এক সাধারণ কর্মচারীর মত মাস মাইনেতে কাজ করবো।  তুমি যদি  রাজি না  হও কোনও সমস্যা নেই, আমি অন্যত্র চাকরি খুঁজে নেব। 

সমস্ত বিষয়টি কেয়ার কাছেও জলের মত পরিষ্কার, সে নিজের ভুল বুঝতে পারল। অনুশোচনা ও গ্লানিতে ছিন্ন-ভিন্ন। মা-বাবাও বারবার বুঝিয়েছিলেন শাশুড়ি নেই, ও বাড়িতে তোর এক বৃদ্ধ সন্তান ও স্বামী আছে,  তাদের ঠিকমতো সেবাযত্ন করতে। কি ভাবে এতবড় ভুল করে ফেলল বুঝতেই পারে নি আর আবিরকেও সে বুঝতে ভুল করেছে। কেয়া শুধু নিজের কাছে নয়, বাবা-মায়ের নজরেও নীচে নেমে গেছে। আবিরকে বলল আমাকে মাফ করে দাও, কথা দিচ্ছি, আর কোনও দিন এরকম ভুল হবে না।

আবির শুকনো হেসে বলল, কেয়া আমি কোনও নাটক করছি না, এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন। বাবার দিকে ঘুরে বলল - বাবা এটাই একমাত্র উপায় -   *তবেই তো তোমার বৌমা বুঝতে পারবে দইয়ের আসল মূল্য কি?*

চল বাবা দেরি হয়ে যাচ্ছে - আবির তাগাদা দিল।

প্রকাশের সময়:০৫/১১/২০১৮, ১:০০ মি:

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !