মুন্সিয়ারি - কুমায়ুনের কাশ্মীর

এডমিন
0
মুন্সিয়ারি - কুমায়ুনের কাশ্মীর 

মুন্সিয়ারি উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলার কুমায়ুন অঞ্চলে অবস্থিত এক নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র এবং শৈল শহর। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ২,২০০ মিটার। মুন্সিয়ারি এক ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ। এখান থেকে চীন সীমান্ত খুব কাছেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে মুন্সিয়ারি কুমায়ুন পাহাড়ের রানি এবং আদর করে ছোট শহরটাকে হিমনগরী বলে ডাকে।। শহরের ভিড় থেকে হাঁফ ছেড়ে যদি কয়েকদিন নির্জনে একান্তই প্রকৃতির সঙ্গে কাটাতে চান তবে আপনার সঠিক গন্তব্য মুন্সিয়ারি আর যদি আপনি প্রকৃতি প্রেমিকের সাথে সাথে বরফ আপনার প্রিয় হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা৷ আপনার গন্তব্যের সময় যদি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের মধ্যে হয় তবে মুন্সিয়ারি পৌঁছানোর প্রায় ৩-৪ কিমি আগে থেকেই চোখে পড়বে রাস্তার দু’পাশে কয়েক ফুট পুরু বরফের চাদর, একথায় তুষারশুভ্র মুন্সিয়ারি৷ প্রথম দর্শনেই শীতের মুন্সিয়ারি আপনার লম্বা যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেবেই৷ অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সঙ্গে সমগ্র পঞ্চচুল্লি রেঞ্জ আর মুন্সিয়ারির বরফ-ঢাকা জঙ্গল ও পাহাড়ের ঢালে ঢালে পাইন, দেওদারের সবুজ সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দেয় এবং মনে অনন্য অনুভূতির সঞ্চার হয়৷ সূর্যাস্তের সময়ে সাক্ষী হতে পারেন এক অপার্থিব সূর্যাস্তের৷  এখান থেকেই কুমায়ুন পাহাড়ের একাধিক জনপ্রিয় ট্রেকিং পথেরও শুরু।




মুন্সিয়ারির ইতিহাস ঃ – এই ছোট শহরটির গুরুত্ব সেই প্রাচীন কাল থেকেই। লবণ ও অন্যান্য সামগ্রী তিব্বতে রপ্তানি করা হত এবং তিব্বত থেকে বিভিন্ন রকমের ভেষজ ঔষধি ও পশম উল আমদানি করা হত। মুন্সিয়ারি জোহার ভ্যালীর মুখ্য পথ অর্থাৎ সদর দরজা। এই পথ দিয়েই মিলম, রালাম ও নামিক নামক তিন তিনটি গ্লাসিয়ারে পৌঁছনোর দ্বার। মিলম গ্লাসিয়ার থেকে উত্তরাখণ্ডের অন্যতম মুখ্য নদী গৌরিগঙ্গার উৎপত্তি, পরে জৌলজিবি নামক একস্থানে কালি নদীর সাথে মিশে যায়। বহু প্রাচীন কালে এই অঞ্চল ছিল মূলত: শোউকা/রঙ উপজাতির মুল উৎস, এই জনজাতির লোকজন ভুটিয়া নামেও সুপরিচিত। এই শতাব্দী পুরনো মানবরাই তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের পরই ভারত-তিব্বত সীমা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়, পরে জীবিকার তাগিদে এই অঞ্চলের লোকজন অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। 

মুন্সীয়ারি সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনী ঃ স্থানীয় লোকমুখে শোনা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মহাকাব্য মহাভারতের পাণ্ডবগণ মুন্সিয়ারী থেকে স্বর্গযাত্রা শুরু করেছিলেন । কথিত আছে পঞ্চচুল্লি পর্বতমালার পাঁচটি মুখ্য শৃঙ্গ, যা দেখতে অনেকটা মাটির চুলা/উনুনের মত, সরল ভাষায় বোঝালে ঠিক যেমন ইট ভাটার উঁচু চিমনির মত,  এই উনুনের উপর চাপিয়ে দ্রোপদি নাকি শেষ বারের মত নিজের হাতে রান্না করে তার পাঁচ স্বামীকে যত্ন করে খাইয়েছিলেন। 

থামরিয়া কুণ্ড – এক ছোট্ট দীঘি, পরিষ্কার টলটলে জল, চারিপাশে সবুজ বন। লোকমুখে কথিত আছে এই কুণ্ডে পরীরা নিয়মিত স্নান করতে আসে, প্রাচীন কালে দুটো হাঁস পুকুরের জল সর্বদা পরিষ্কার করে রাখত। এক স্থানীয় শিকারি একটি হাঁসকে মেরে দেয় এবং পরীদের অভিশাপে শিকারির দুটি হাতই নাকি নষ্ট হয়ে যায়। দিঘীর জলে একটিও পাতার দেখা পাওয়া যায় না। লোকমুখে চর্চিত, এখনও নাকি একটি হাঁস আসে এবং পূর্ণিমার রাতে চলে জল পরীদের জলকেলি।        
            
মুখ্য আকর্ষণ: 

  • এখানকার মুখ্য আকর্ষণ শৃঙ্গদর্শন। একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পঞ্চচুল্লি পর্বতমালা৷ এই পর্বতমালার অন্যতম শৃঙ্গগুলি হল নন্দাদেবী, নন্দাকোট,রাজারাম্ভা ও নেপালের হিমালয়।  
  • আপনি যেখানেই যান পঞ্চচুল্লি থেকে থেকে আপার চোখ টেনে নেবেই৷ রাস্তার প্রতিটি মোড়েই পঞ্চচুল্লিকে পাবেন নতুন নতুন রূপে৷ একটা সময় দেখবেন নেশা চেপে বসেছে যে দেখি আর কতগুলো নতুন কোণ পাওয়া যায়৷ তবে সবচেয়ে ভালো ভিউ পাবেন নন্দাদেবী পার্ক থেকে৷ 
  • পঞ্চচুল্লির বুকে সূর্যাস্তের রংবদলের দৃশ্য দেখার মতো।
  • পাহাড়ের ঢালে পাইন, দেওদারের সবুজ সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্রামছোঁয়া পাহাড়ের গায়ে চাষও হচ্ছে ধাপ কেটে।
  • শহরের মধ্যে রয়েছে ট্রাইবাল হেরিটেজ মিউজিয়াম। খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা।
  • এপ্রিল মাসের দিকে দেখতে পাবেন রঙবেরঙের ফুলে ভরা পাহাড় তৎসহ ওক, পাইন আর রডোড্রেনের জঙ্গল।    
  • চোখ বন্ধ করলে শুনতে পাবেন নানান ধরণের অজানা পাখির ডাক, বিশেষ করে মোনাল। মোনাল উত্তরাখণ্ডের জাতীয় পাখি তৎসহ নেপালের রাষ্ট্রীয় পাখি। এই পাখি কিছুতেই সামনে দেখা মেলে না। মোনাল ছাড়াও ওয়াগটেল, বাজ, হিমালয় গ্রিফন এবং শিকারি ঈগল।
  • পশু মধ্যে লেপার্ড, হিমালয়ান ভালুক, শেয়াল, হরিণ অন্যতম।  
কোথায় কোথায় যাবেন ও কি কি দেখবেন: 

  • বিরথি জলপ্রপাত - মুন্সিয়ারি পৌঁছনোর ৩৫ কিমি আগে দেখতে পাবেন বিরথি জলপ্রপাত।১২৬ মিটার উপর থেকে পড়ছে অবিরাম জলধারা, সবুজের সাথে সূর্যের সোনালি আভায় ফুটে ওঠে এক অপূর্ব দৃশ্য। ঠিক এক পাশেই আছে কুমায়ুন মণ্ডলের অতিথিশালা।
  • বালান্তি ভিউ পয়েন্ট/বালান্তি পটাটো ফার্ম ঃ মুন্সিয়ারি থেকে ২ কিমি দূরে ৯০০০ফুট উপরে অবস্থিত এই জায়গা, এখান থেকে পঞ্চচুল্লি সহ অনান্য পর্বত শৃঙ্গের দৃশ্য দেখার মতো।
  • মদকোট গ্রাম – এখানেই গৌরিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাবিত স্থল।মুন্সিয়ারি থেকে ২১ কিমি দূরে।        
  • কালামুনি পাসে রয়েছে (১০ কিলোমিটার) নাঙ্গাবাবার কালীমন্দির।
  • ২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে নন্দাদেবীর মন্দির ও হিমালয় দর্শনের ভিউ পয়েন্ট।
  • ১২ কিলোমিটার দূরে দেখবেন আদিবাসী গ্রাম দারকোট।
  • গৌরীগঙ্গা নদী লাগোয়া উষ্ণ প্রস্রবণটি ২২ কিলোমিটার দূরে।
  • খুব কাছেই থামরিয়া কুণ্ড জলাশয় ( মুন্সিয়ারি থেকে ৯ কিমি) , খালিয়াটপ বুগিয়াল (এখানে একরাত কাটালে খুব ভালো লাগবে)ও মেহসার কুণ্ড। এই তিনটি জায়গায় পৌঁছতে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শীতকালে এইসব পথ বরফে ঢাকা থাকে।


মুন্সিয়ারি থেকে ট্রেকিং ঃ কুমায়ুন পাহাড় একাধিক জনপ্রিয় ট্রেকিং পথের জন্য বিখ্যাত। আর এই মুন্সিয়ারি থেকে শুরু হয়েছে জনপ্রিয় ট্রেকিং পথ। 

১। নামিক গ্লাসিয়ার ট্রেকিং – পিথোরাগড় জেলার কুমায়ুন হিমালয়ের গোগিনা ও নামিক গ্রামে সমুদ্র তল থেকে প্রায় ৩৬০০ মিটার উপরে অবস্থিত এই গ্লাসিয়ার। মুন্সিয়ারি থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি। এর চারিপাশ ঘিরে রয়েছে উঁচু উঁচু শৃঙ্গ যেমন নন্দাদেবী (৭৮৪৮মি), নন্দাকোট (৬৮৬১মি) এবং ত্রিশূল (৭১২০মি)। পথিমধ্যে দেখা যাবে সুন্দর সুন্দর পাহাড়ি ঝর্না যা স্বর্গীয় সুখের অনুভব জাগায়।এই নামিক গ্লাসিয়ার থেকেই বিখ্যাত রামগঙ্গা নদীর উৎপত্তি, দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে এই নদী উত্তর প্রদেশের নরোরার কাছে গঙ্গা নদীর সাথে মিশে যায়। 

২। পঞ্চচুল্লি ট্রেকিং ঃ- এই পর্বতমালা মুলতঃ পাঁচটি উঁচু উঁচু শৃঙ্গ নিয়ে গঠিত, প্রায় সারাবছরই সাদা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে। এই পর্বতমালা সমুদ্রতল থেকে ৬৩৩৪ মি থেকে ৬৯০৪ মিটারের মধ্যে।          


কখন যাবেন ঃ বেড়ানোর পক্ষে আদর্শ সময় এপ্রিল থেকে জুন আর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস। 

কি ভাবে যাবেন ঃ- 
রেল পথ ঃ- 
১। কোলকাতা/হাওড়া থেকে সরাসরি বাঘ এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম/হলদ্বানি স্টেশন পর্যন্ত, তবে এই ট্রেনে না আসায় ভাল, দীর্ঘ পথ, পৌঁছতে প্রায় ৪০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।  
২। হাওড়া থেকে লালকুয়া পর্যন্ত সাপ্তাহিক সুপার ফাস্ট ট্রেন, সময় মোটামুটি ২৫ ঘণ্টা লাগে। লালকুয়া থেকে অটো বা ছোট্ট গাড়িতে কাঠগোদাম/হলদ্বানির দুরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। 
৩। হাওড়া/শিয়ালদহ থেকে বেরেলি জং স্টেশন পর্যন্ত প্রচুর ট্রেন। বেরেলি স্যাটেলাইট বাসস্ট্যান্ড থেকে কাঠগোদাম/হলদ্বানি বাসে ১১৮ কিমি, ভাড়া প্রায় ১২০ টাকা প্রতিজন।
৪। হাওড়া/শিয়ালদহ থেকে নতুন দিল্লি, সেখান থেকে প্রতিদিন ৩ জোড়া ট্রেন কাঠগোদাম/হলদ্বানি স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করে।          
পরবর্তী মুন্সিয়ারি পর্যন্ত যাত্রা বাসে বা ছোট গাড়িতে ভায়া আলমোড়া হয়ে প্রায় ২৮০ কিমি দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তা।  

কোথায় থাকবেনঃ মুন্সিয়ারিতে থাকার জন্য অল্প সংখ্যক হোটেল আছে। ৩৫ কিমি আগেই পড়বে বিরথি জলপ্রপাতের সামনে  কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট লজ(০৯৪১০৯-১৩১৬৩), ভাড়া ৫০০-৮০০ টাকা, বুকিং অন-লাইনে করতে পারেন। 

কি খাবেন ঃ- খুব ভালো ও উন্নতমানের খাবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে রাস্তার ধারে ছোট্ট ছোট্ট খাবার স্টল পাবেন সেখানে উত্তর ভারতীয় খাবারদাবার পাওয়া যায়। এছাড়াও জনপ্রিয় চাইনিজ খাবার সহজলভ্য যেমন নুডলস, মোমো ও স্থানীয় কুমায়ুনি খাবার।   

লেখক পরিচিতি ঃ এম ওয়াসিক আলি, একজন আইটি প্রোফেশনাল ও ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীন উত্তরাখণ্ডের এক জলবিদ্যুৎ পাওয়ার স্টেশনে কর্মরত।
স্বত্ব সংরক্ষিত @এম ওয়াসিক আলি।      

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !