জোর যার মুলুক তার

এডমিন
0
শ্রীমান তোতারাম গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তি, বেশ নাম ও হাঁকডাক। তার এমনই প্রভাব প্রতিপত্তি যে তার ভয়ে গ্রামে বাঘে ও গোরুতে এক ঘাটে জল খায় । কথায় কথায় দু নালা বন্ধুকের হম্বিতম্বি আর গালিগালাজ ও খিস্তির কথা বাদ দেওয়াই ভালো। বেচারা গ্রামবাসীরা, প্রায় সকলেই দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে, তাদের এমনই অবস্থা যেন নুন আনতে পান্তা ফুরোই, সামান্যতম বিরোধিতার করারও কারো মুরোদ নেই। অগত্যা সব কিছুই মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। আজকের গল্পের অন্যতম ২টি মুখ্য চরিত্র শ্রীমান তোতারামের বাঁধা মুনিষ কালু আর অকর্মণ্য চাষের বলদ, যে কাজ কম করে আর খড়-ভুসো বেশি বেশি মাত্রায় ধ্বংস করে।
শ্রীমান তোতারাম তার বলদ নিয়ে এতটাই ক্ষিপ্ত যে বলদটিকে দেখলেই নাকি প্রেশার হাই হয়ে যায়। সে মনে মনে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন আর নই অনেক হয়েছে, এবার অকর্মণ্য পশুটাকে বিদেয় না করতে পারলে সংসারে ঘোর অনটন আসবে।যেমন ভাবনা তেমনি কাজ, পরদিন সকাল সকাল, কাজের মুনিষ কালুকে নিয়ে প্রায় ২৪ কিমি দূরে এক পশুহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। বেচার বলদ কিছু বোঝার আগেই ভিটেছাড়া, মন খারাপের কিছুই বোঝে না।
২৪ কিমি বেশ দূর, উপরে চাঁদিফাটা গরম, এমন পরিস্থিতিতে কালু আমতা আমতা করে শ্রীমান তোতারামের সমুখে কথাটি পাড়লেন।
মালিক – কালু হাতজোড় করে বলল । আপনি যদি অভয় দেন একটা কথা বলি।
শ্রীমান কটমট দৃষ্টিতে কালুর দিকে দেখলেন এমনই ভাব যেন এখুনিই গিলে খাবে। কালুর হাড় হিম হয়ে এলো।
বল – শ্রীমান আদেশ দিলেন।
কালু মালিকের দিকে সাহস করে বলল, ২৪ কিমি তো বেশ দূর, বেচারা গোরু অতটা পথ এই গরমে ঠিক মত চলতে পারবে না, মাঝে ২-৩টে জায়গার কিছুক্ষণ বিশ্রামের দরকার এবং সাথে সামান্য কিছু ঘাস ঘাসালি ও জল দিলে বলদটির পুরো বিশ্রাম পাবে ফলে অতটা পথ চলতে কোনও অসুবিধা হবে না। তাই বলছিলাম কি অল্প কিছু ঘাস কিনলে ভালো হয়।আর হ্যাঁ আপনিই বা কেন অতটা পথ পায়ে হেঁটে যাবেন, বরং আপনি বাসে চলে যান, আমি বলদটিকে নিয়ে ধীরে সুস্থে এগোচ্ছি।
বলেই কালুর বুক দূরদূর করতে লাগল।
শ্রীমান তোতারাম পুনরায় কটমট করে কালুর দিকে দেখলেন আর বললেন – খুব জ্ঞানী হয়ে গেছো দেখছি, দরদ একেবারে উথলে পড়ছে, তাই না? নিজের ঘর-দুয়োর বেচে কিনে নাও!!! কেমন?
খালি-খালি টাকা ওড়ানোর ধান্ধা, নিকর্মা কোথাকার, শ্রীমান গজগজ করে এগিয়ে গেলেন।
অগত্যা কালু আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ মালিকের পেছন ধরলো।
পশুহাট পৌঁছতে আর মাত্র ২-৩ কিমি বাকি, মধ্য গগনে উত্তপ্ত সূর্যদেব যেন শত্রুর উপর সমানে গরম আগুনের গোলা বর্ষণে ব্যস্ত। ক্ষুধা ও তৃষ্ণার চোটে বেচারা বলদ একেবারেই কাহিল।ক্রমাগত পথ চলতে চলতে বেচারার চলার নুন্যতম শক্তিটুকুও নেই। ক্রমশ দু জোড়া পা অবশ হয়ে আর চলতে না পেরে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল, একটু এদিক ওদিক নড়াচড়া করার পর সব শান্ত।
শ্রীমান তোতারামের মাথায় যেন সমস্ত আকাশ মেঘ-সুদ্ধ সজোরে ভেঙে পড়ল, মৃত পশুর পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে গেল, চোখের সামনে যেন সব কিছুই অন্ধকার।
বেচারা কালু হতভম্ভ, কি করবে বুজতে পারছে না, মনে মনে ভাবল মালিকের অবস্থা আবার গোরুর মতো না হয়।
কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হওয়ার পর শ্রীমান তোতারাম, কালুর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দেখল আর বলল – শুয়োরের বাচ্চা আমার কর্মঠ বলদকে মেরে ফেললি!!!
এবার কালুর অজ্ঞান হওয়ার পালা।
তোকে এর মূল্য চুকাতে হবে মনে রাখিস। কালুকে ছেড়ে শ্রীমানজী বিদেয় নিলেন।
পরদিন সন্ধ্যায় গ্রামের সালিশি সভায় সর্বসম্মত ভাবে গ্রামের বাকি জ্ঞানীগুণী বিদ্বজ্জনেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন বেটা কালুই শ্রীমান তোতারামের বলদের মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং কালুকে এর জন্য কুড়ি হাজার টাকা জরিমানা ধার্য হল, অবশ্য দয়াবান শ্রীমান তোতারামের দয়ার জন্যই নাকি পাঁচ হাজার টাকা কম জরিমানা ধার্য করা হয়েছে!!
বেচারা কালু অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার আর্জি কেউ কর্ণপাত করল না। কাঁদো কাঁদো সুরে হাতজোড় করে বলল আমার কাছে কুড়ি টাকাও নেই এত টাকা কি করে জরিমানা দেবে।
মোটামুটি সভাস্থ সকলেই কালুর আর্থিক বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাই সকলে মিলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন “ কালুর চিলতে চালের ঘরের মালিক হবেন শ্রীমান তোতারাম এবং তৎসহ কালুকে সস্ত্রীক ১ বছর শ্রীমানের ঘরে নিজের খেয়ে বিনা মজুরীতে কাজ করতে হবে“।
সভা শেষে ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে এলো, কালু অপলকে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।অবলা পশুকে হাটে পৌঁছানোর এমন প্রতিদান ভাগ্যে জুটবে কালু কল্পনাতেও ভাবে নি।


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !