রিমার হটসআপে ফ্রেন্ড-লিস্টে কিছু ছেলে বন্ধুর নাম এবং তাদের সাথে চ্যাট ও মেসেজ পড়ে সুমন রাগে অগ্নিশর্মা। প্রচন্ড রাগে চোখমুখ একেবারে লাল এবং ঠোঁট কাঁপতে শুরু করেছে।
রিমা........রিমা আ আআআ......
রাগে , ক্রোধে মনে হচ্ছে যেন জ্ঞানগর্ম হারিয়ে ফেলেছে। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। ঠোঁট দুটি শুকিয়ে যাচ্ছে, সে কিছুতেই ভাবতে পারছে না, রিমা বন্ধুদের সাথে চ্যাটে মশগুল। পিঠ পেছনে এই সব কুকীর্তি চলছে। যদিও চ্যাটের বিষয়বস্তুগুলো অতি সাধারণ, একটু আধটু হাসি মজাক, চুটকুলে যেমন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে হয়ে থাকে। দু একজন বন্ধু অবশ্য রিমার সুন্দরতার প্রশংসা একটু বেশি মাত্রায় করে ফেলেছে, যা আগুনে ঘি-এর কাজ করেছে, ঠিক যেমন তেলে-বেগুনে জ্বলে যাওয়ার মত অবস্থা।
রিমা আর সুমনের বিয়ের মাত্র সাত দিনই হয়েছে, গায়ের হলুদ ও হাতের মেহেন্দি এখনও টকটকে, এরই মাঝে এমন ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত!!
রিমা, রিমা........ সুমনের গলার আওয়াজ ক্রমেই বাড়ছে।
কি হয়েছে? চিৎকার শুনে রিমা একটু বেশি ভয় পেয়ে গেছে এবং তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেডরুমে দৌড়ে গেল। অশুভ কিছু ঘটেছে ভেবে রিমার শশুর, শাশুড়ি আর ননদ কল্পনাও হাজির।
জ্ঞানগর্ম, বোধ-বুদ্ধিহীন সুমন সকলের সামনেই রিমাকে অপমান করা শুরু করেছে।
কি হয়েছে সুমন বৌমার উপর চিল্লাচ্ছিস কেন? মায়ের দিকে ঘুরে বলল, তোমার গুণধর বৌমার হটসআপ খুলে দেখো!! ফ্রেন্ডলিস্ট পুরুষ বন্ধুদের ছড়াছড়ি আর পিঠ পেছনে কি চলছে নিজেই বুঝতে পারবে!! তোমার গুণধর বৌমা চ্যাটিং এ মশগুল। এ ভালো মেয়ে নয়, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি মা।
রিমা লক্ষ্য করল, শশুর, শাশুড়ী ও ননদ জ্বলন্ত চোখে তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন গিলে খাবে।
রিমা কিছুক্ষণ বাক্যহীন একপলকে সুমনের দিকে চেয়ে রইল, কি আজেবাজে কথা ভাবছে সুমন। এই কি সেই সুমন!, যার জন্য বাবার পছন্দের আর্মির সুদর্শন ক্যাপ্টেনকে রিজেক্ট করেছে, নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে, এমন নীচ মেন্টালিটির মানুষ যে সুমন হতে পারে, সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে, ভালো চাকুরী, কথাবার্তায় অসম্ভব শালীনতা, বিয়ের আগে মিষ্টি মধুর কথার ফুলঝুরি, আর এখন কোন সুমনকে দেখছে সে!! সুমনের এই রূপ স্বপ্নেও কল্পনা করে নি।
শান্ত সুরে রিমা বলল, তুমি যাদের কথা বলছ, তারা সকলেই আমার পুরোনো ক্লাস মেট অথবা পূর্বপরিচিত। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা কি খারাপ? আর হ্যাঁ সুমন, আমিও তোমার হটসআপ লিস্টে তোমার মেয়ে বন্ধুদের লম্বা লিস্ট ও তাদের সাথে চ্যাটিং দেখেছি, আমি তো বিষয়টি খারাপ ভাবে নিইনি। শুধু তাই নয়, তোমার বোনের হটসআপ চেক করে দেখো সেখানে অনেক ছেলেদের নাম্বার আছে। হতে পারে তারা খুবই ভালো বন্ধু, এতে খারাপ ভাবার কি আছে?
চুপ, ছোট মুখে বড় কথা, নিজের দোষ ঢাকতে অন্যের উপর চাপানো হচ্ছে!! শাশুড়ি চিৎকার করে বলল।
চটাস......। সুমন রিমার গালে একটা কষে চড় মারল। রিমার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে গালে পাঁচটি আঙুলের দাগ পড়ে গেল।
একটু ধাতস্থ হওয়ার পর রিমা সুমনের দিকে দেখলো, তার মুখমন্ডলে প্রশান্তি, যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে এবং বাকি সদস্যরাও বেশ প্রসন্ন, হয়তো মনে মনে ভাবছে, ভালোই ডোজ পড়েছে, এই অব্যর্থ ওষুধ খুব ভালো কাজ হবে। শুরুতে এমন ডোজ খুব কাজে আসে।
আবার সজোরে চটাস..... এবারের শক্তিশালী আওয়াজ সমস্ত বেডরুমের কোণে কোণে প্রতিধ্বনিত হল। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বেডের কোণে সুমন বসে পড়েছে, থাপ্পড় এতো জোরালো ছিল চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে।
বাঁ-কানটি ভোঁ ভোঁ করছে, বউয়ের হাতে এত জোর! সুমন হতবাক। এমন শক্তিশালী থাপ্পড়, চাঁদ, তারা এমনকি উপগ্রহও চোখের সামনে বন বন ঘুরতে শুরু করেছে। বেচারা সুমন! তাও আবার সমস্ত পরিবারের সামনে।
নিমেষে পরিবেশ একেবারে থমথমে, সকলেই ভয়-ভীত।
দ্বিতীয় ভাগ পড়ার জন্য নিচের লিঙ্ককে ক্লিক করুন : #নারীর_কার্তীত_মহিমা_দ্বিতীয়_ভাগ
রিমা সুমনের উদ্দেশে বলল - "ভুল করেও আমাকে আর পাঁচটা অবলা অসহায় নারীর মত ভেবো না, আমি উচ্চ শিক্ষিতা, আধুনিক যুগের সবলা নারী, নিজের অধিকার ও নিজের কর্তব্য, নিজের জিম্মেদারী সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল, কি ভুল, কি ঠিক বোঝার মত যথেষ্ট ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন"।
রিমা আরও বলল--" আমি যে আর্মির মেজরের কন্যা সেটা অবশ্যই মনে রাখবে, নিজেকে কি ভাবে রক্ষা করতে হয়, সেটা খুব ভালো করে জানি, নিজের চরিত্র কি ভাবে ঠিক রাখতে হয় সে শিক্ষাও আমার আছে। আর হ্যাঁ, এরপর যদি কেউ আমাকে মানসিক বা শারীরিক কষ্ট দেওয়ার এতটুকুও চেষ্টা করে অথবা আমার মান-সম্মান, ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করে, আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না, সোজা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস ঠুকবো এবং পরবর্তীতে ভোগান্তির জন্য আপনারা নিজেই দায়ী থাকবেন"।
সুর একটু নিচু করে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,আপনিও তো মহিলা, আপনাকে নিজের মায়ের স্থানে বসিয়েছি, বাল্যকাল থেকেই মায়ের স্নেহ, আদরের কাঙাল, অন্ততঃ আপনার কাছ থেকে এরূপ ব্যবহার আশা করিনি। প্লিজ ভুল বুঝবেন না, আপনাকে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি মা, আপনি ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে শুধু উচ্চ পদস্থ পদে অধিষ্ঠিতই করেছেন কিন্তু আসল শিক্ষাটুকু দিতে পারেন নি। আপনারা হয়তো ঠিকমতো শেখাননি কি ভাবে মহিলারদের সাথে কথা বলতে হয় আর তাদের কি ভাবেই বা
সম্মান করতে হয়!
এই ঘটনার পর বাড়ির পরিস্থিতি বেশ থমথমে। পরিবার দু ভাগে বিভক্ত, একদিকে একাকী বৌমা আর অন্য দিকে বাকিরা। কথায় বলে দেওয়ালেরও কান থাকে। এমন চটপটে মশলাদার খবর বেশি দিন চাপা থাকে না, একান ওকান হয়ে শীঘ্রই পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশ চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। পড়ালেখা, উচ্চ শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী আদর্শ বৌমা কেমন হয় তাও ফলাও করে প্রচারিত হল। এমনকি যাঁরা পুত্রদের বিবাহের কথা ভাবছিলেন এই ঘটনার পর অনেকেই সতর্ক। বলাবলি শুরু হয়েছে বৌমা যেন ওবাড়ির মত না হয় আর ভগবান যেন ভুল করেও ওরকম বৌমা কোন শত্রুর ভাগ্যে না দেন ইত্যাদি ইত্যাদি ....।
হঠাৎ করেই রিমা সুন্দর, সুশীল, শিক্ষিতা, আধুনিক নারী থেকে ঝগড়াটে বৌমার উপাধিতে ভূষিত হল।
এই ঘটনার মাসখানেক পরে, সুমন আর তার বাবাকে বিশেষ কাজে দূরে এক অন্য শহরে যেতে হয়। বাড়িতে সুমনের মা, বোন আর রিমা। সুমনের
ছেড়ে যেতে খুব ভয় হচ্ছিল, কি জানি রিমা আবার কি করে বসে। মা ও বোনকে পঁই পঁই করে সব কিছু পাঠপড়া করে বুঝিয়ে দিয়েছে যেন নতুন করে কোনও রকমের ঝুটঝামেলায় না জড়িয়ে পড়ে। সেদিনের ঘটনার পর সম্পর্ক এখনোও স্বাভাবিক হয় নি, বরং তিক্ততা আরও বেড়েছে। রিমা অবশ্য দু-একবার চেষ্টা করেছে মিটমাট করার, তবুও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয় নি।
সুমন চলে যাওয়ার পর রিমার আরও খালি খালি লাগছিল, কিছুই করার নেই, মা সেই ছোট বেলাতেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ভগবানের কাছে পৌঁছে গেছে, বাবার ডিউটির ঠিক ঠিকানা নেই, কোথায় যাবে সে? সত্যি কি সে অপয়া? ভর সন্ধ্যায় শুয়ে শুয়ে এইসব সাত পাঁচ ভাবছিল।
হঠাৎ করে ননদের কান্নার শব্দে ঘোর কাটল, কান পেতে পরিষ্কার শুনতে পেল, "বৌদি ও বৌদি তাড়াতাড়ি এসো মাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে"।
বাইরে এসে দেখে বাথরুমে শাশুড়ি অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে এবং মাথা থেকে গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। চিৎকার শুনে আশেপাশের কিছু পাড়াপ্রতিবেশী বাড়ির সামনে হাজির, উদ্বিগ্ন সকলে পুরুষশূন্য বাড়িতে রিমা আবার কোনও অঘটন ঘটালো নাকি? এত রক্ত দেখে, কিছু বলা বা করার আগেই কল্পনা অজ্ঞান। বাইরে ঠাসা ভিড়।
রিমা নিজেকে সংযত করে খুব ঠান্ডা মাথায় প্ৰথমে শাশুড়ির ক্ষতস্থান কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধলো, ফলে রক্তক্ষরণ কিছুটা কমল এবং দৌড়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল এনে ননদের চোখে মুখে ছিটে দিল। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই কল্পনা চোখ খুলল,তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। রিমা সর্বপ্রথম গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করল এবং শাশুড়িকে অন্যদের সহায়তায় কোনরকমে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলল আর কল্পনাকে বলল শিঘ্রী তালা দিয়ে গাড়িতে বসতে।ঝড়ের বেগে সোজা নিকটবর্তী নার্সিং হোমে হাজির। কল্পনা ফ্যালফ্যাল করে দেবীরুপী বৌদিকে দেখছিল।
নার্সিং হোমে পৌঁছেই সব ফার্মালিটি করার পর শাশুড়িকে ICUযে সত্বর ভর্তি করালো, অনেক রক্তপাতের ফলে অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। যেহেতু চোট অনেক গম্ভীর তাই খুব তাড়াতাড়ি রক্ত দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে রিমারও ব্লাড গ্রুপ একই, তৎক্ষণাৎ রিমা নিজের রক্ত দান করে এক ইউনিট রক্ত জোগাড় করল।
আধঘণ্টা পর অপারেশন রুম থেকে খবর এলো, মাথায় 7টা সেলাই পড়েছে, রোগীর এখনোও জ্ঞান ফেরেনি,তবে হার্টবিট ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে। রিমা বৌমা নয় ঠিক যেমন ছেলের মতই সমস্ত কর্তব্য ঠিক ঠিক ভাবে পালন করল। এমন পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় সব কাজ হয়তো সুমনও সুষ্ঠুভাবে করতে পারতো না। ইতিমধ্যে কল্পনা সুমনকে ফোন করে ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছে, তাদের আসতে মিনিমাম 4-5 ঘণ্টা লাগবে।
সারা রাত রাত জেগে রিমা শাশুড়ির সেবা যত্ন করলো, কখনও জল, কখনো ওষুধ, কখনো মাথায় পট্টি, রাত 4 টার দিকে সুমন যখন নার্সিং হোমে পৌছালো তখনও রিমা জেগে, পাশের ভিজিটার বেড়ে কল্পনা ঘুমিয়ে আছে।
সকাল 6টার দিকে জ্ঞান ফিরল, সামনে স্বামী, পুত্র ও কন্যার উদ্বিগ্ন মুখ। হঠাৎ করে রিমার দিকে চোখ পড়লে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।
রিমা মনে মনে হাঁসলো। কল্পনা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে উঠে বৌদিকে জড়িয়ে ধরল, মা ও বাকি সকলেই অবাক, জিজ্ঞাসার চোখে কল্পনার দিকে দেখলো।
জ্ঞান ফেরার খবর শুনে মেট্রন ছুটে এলেন, রোগীর পালস রেট চেক করার পর বললেন-এখন কেমন লাগছে?
রিমার শাশুড়ি অস্ফুটস্বরে বলল ভালো। মেট্রনকে কাছে ডেকে বলল , জান বাঁচানোর জন্য আপনাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মেট্রন বললেন, ধন্যবাদ যদি দিতেই চান তাহলে আপনার বড় মেয়েকে দিন! এমন সাহসী ও বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি।
বড় মেয়ে! একটু অবাক হয়ে মেট্রনের দিকে চাইল। মেট্রন ইশারায় রিমাকে দেখালো। ততক্ষণে কল্পনা বৌদিকে আবার জড়িয়ে ধরেছে।
মেট্রন চলে যাওয়ার পর কল্পনা গতকালের সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে শোনালো। বলল, মা তোমার আসল মেয়েই তোমার প্রাণ রক্ষা করেছে।
গতকাল পর্যন্ত যে বৌমার মুখ দেখলে ঘেন্না করত, সেই মেয়েই কিনা এতো সব করেছে, চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা আর নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা জল পড়ল। ওদিকে রিমার চোখেও জল। সদ্য পাওয়া বড় মেয়েকে আদরে পাশে ডেকে বসালো আর কম্পিতস্বরে বলল - ক্ষমা করে দে মা!!
সুমন নির্বাক, সেই বা কেমনে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে.....।
প্রকাশের সময়:০২/১১/২০১৮, ৩:৩৮ মি: