সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অনীশ ঘন-ঘন মোবাইলে সময় দেখছিল। সময় আর কিছুতেই কাটছে না।চাকরিতে জয়েন করার পর প্রথমবার বাড়ি যাচ্ছে। মনের মধ্যে আলাদা অনুভূতি। ব্যাগভর্তি গিফট বাড়ির সকলের জন্য। মায়ের জন্য অবশ্যই বিশেষ উপহার। ট্রেনটি আসার কথা প্রায় 50 মিনিট আগেই, কিন্তু এখনও পাত্তা নেই। খুব বিরক্ত বোধ করছে, কতই বা নেট সার্ফিং করে সময় কাটাবে।
হঠাৎ, পাশের খালি সিটে এক সুন্দর মহিলা এসে বসলেন। অনীশ এমনিতেই মেয়েদের দেখলে শ-ক্রোশ দূরে পালিয়ে বেড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে এক সুন্দরী মহিলা পাশে বসায়, সে খুব ঘাবড়ে গেল ও অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি?
অনীশ উঠতে যাচ্ছিল,হঠাৎ মহিলাটি বলল, বসুন-বসুন, ভয় পাবেন না। অগত্যা বসে পড়ল এবং বসে বসে সাতপাঁচ ভাবতে শুরু করল, কে এই মহিলা? কেন বসতে বললো, কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ উসখুস করার পর অনীশ ভাবল, না আর এখানে বসা যাবে না, খুবই অস্বস্তি হচ্ছে। মনে প্রাণে বাঁচার জন্য উঠে পড়ল, তৎক্ষণাৎ মহিলাটি অনীশের হাত ধরে বসাল।
কে আপনি? আমার হাত কেন ধরছেন?
কি ব্যাপার ? এরকম করছেন কেন?
একসঙ্গে অনীশ অনেকগুলো প্রশ্ন করল।
মহিলা একটু হেসে উঠলো, মুখ তুলে বলল, একসাথে এত প্রশ্ন!
একবার আমার দিকে নজর ঘোরালেই বুঝতে পারবেন?
অনীশ এক ঝলক মহিলার দিকে দেখলো।
কি চিনতে পারলে? মহিলাটি মিটিমিটি হাসছে।
অনীশ না সূচক মাথা ঝাঁকালো।
মহিলা উদাস হয়ে বলল- সত্যি সত্যিই কি চিনতে পারছেন না ভনিতা করছেন অনীশবাবু। না নতুন চাকরির নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন।
নিজের নাম শুনে অনীশ চমকে উঠল। আর এত তথ্যই বা কি ভাবে জানলো?
খুব অবাক না? থাক আর আশ্চর্য হতে হবে না, আমি রূপসা।
অনীশের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরলো - "ও"।
মনে পড়েছে? রূপসা বলল।
অনীশ আরও একবার ভালো করে রূপসার দিকে দেখলো, বেশ স্বাস্থ্যবতী, সিঁথিতে সিঁদুর, রীতিমতো রমণী রমণী ভাব, কিন্তু অকালে বয়সের ছাপ স্পষ্ট চোখে পড়ল।
স্মৃতির কোণে জমে থাকা বাদল সরানোর চেষ্টা করল অনীশ। একটু জোর দিতেই ঘটনাক্রমগুলো ধীরে ধীরে জলের মতো স্বচ্ছ, প্রায় বছর পাঁচেকের ব্যবধানে অল্প বিস্তর ধুলোর আস্তরণে পড়েছিল।
অনীশের সামনে সব কিছুই এক এক করে খুলতে লাগল।
রূপসার দিকে তাকিয়ে আরও ভয়ভীত হল। রূপসা অনীশের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল-ভয় পেও না, আমি মোটেও পাগল নয়, আর কোন দিনই ছিলাম না। আর আমি পাগল হলেও তোমার কোনও ক্ষতি করতাম না।
রূপসা পাড়ারই মেয়ে, অনীশের সহপাঠী, দশম শ্রেণী পর্যন্ত একসাথে পড়েছে। তারপর সে সায়েন্স নিল আর রূপসা আর্টস। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন তার মাথায় নাকি ছিট ধরেছিল, পাগলের মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত, অনীশকেও অনেক বিরক্ত করত। তার নিত্য নতুন পাগলামিতে অনীশ অতিষ্ঠ ছিল।
উচ্চমাধ্যমিকের পর অনীশ হোস্টেলে চলে গেল এবং সেখানে থাকাকালীন এক বন্ধুর মুখে রূপসার বিয়ের খবর শুনেছিল, বন্ধুটি রসিয়ে রসিয়ে বিয়ের গল্প শুনিয়েছিল। এও জানতে পেরেছিল, বিয়ের পরেই পাগলী ঠিক হয়ে গেছে। বন্ধুরা সবাই মিলে সেদিন খুব হেসেছিল। অনীশও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
রূপসা অনীশের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, যার জন্য পাগল হয়েছিলাম, সেই কিছু বুঝলো না।
অনীশ আকাশ থেকে পড়ল। মনে তুমি কি বলতে চাইছো?
হ্যাঁ, অনীশ তুমিই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।
কি আজেবাজে বকছো? অনীশের সুর চড়ল।
রূপসা ধীরসুস্থে বলল, ক্লাস টেনে পড়াকালীন, তোমার খাতায় "আই লাভ ইউ" কে লিখেছিল জানো?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, সেটা আমারই কাজ ছিল। তুমি কতই না হাঙ্গামা করেছিলে, সেদিন ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্যারেরা এক এক করে সকলের হাতের লেখা চেক করেও কুল কিনারা করতে পারেন নি। কেন জানো, সে কথাগুলো আমি বাঁ হাত দিয়ে লিখেছিলাম। অনেক বুদ্ধু ও হাবাগবা ছিলে তুমি, সেই বোকামির জন্যই তোমাকে ভাল লাগত, ধীরে ধীরে সেই ভালোলাগা, অজান্তেই ভালোবাসাতে পরিণত হয়। পুরোপুরি প্রেম জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
যখন তখন বিরক্ত করা, কারণে বিনাকারণে তোমার বাড়িতে আসা তোমার মায়ের একদম পছন্দ ছিল না। ধীরে ধীরে একদিন তোমার বাড়ির দরজাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
তারপরেই তো তুমি হোস্টেলে চলে গেলে আর আমি পাগলের মত পাড়ায় পাড়ায় ঘরে বেড়াতাম। বিষয়টি শুধু তোমার মা আঁচ করতে পেরেছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় দেখি হঠাৎ তোমার মা আমাদের বাড়িতে হাজির, আমার বুক দুরদুর করছিল, যা আশঙ্কা করেছিলাম, সত্যি সত্যিই তাই ঘটল। তোমার মা বাড়িতে সবকিছু খুলে বলেলেন, তিনি চলে যাওয়ার পর বাবা শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলেন, কতগুলো সত্যি কি না?
আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম।
বাবা সময় নষ্ট না করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বয়সে প্রায় 15 বছরের বড় এক বুড়োর সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
রূপসা বলেই চলল- আমি খুশি না দুঃখী বলতে পারবো না, তবে বুড়ো স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসে, আমার ছোট্ট ছোট্ট খুশি, চাওয়া- পাওয়াগুলোকে তৎক্ষণাৎ পুরো করেন, দুই সন্তান নিয়ে খুব খুশিতে সংসার করছি।
জানো অনীশ, তবুও একান্তে সব কিছুই খালি খালি লাগে, খাঁ খাঁ করে মনের বাসরঘর। স্বামীকে শরীর সমর্পণ করেছি ঠিকই, কিন্তু আজও মন দিতে পারি নি। সে শুধুমাত্র তোমার জন্য অনীশ।যখনই সে আদর করে, আমাকে স্পর্শ করে, সে স্পর্শে শুধু তোমাকেই অনুভব করি।
আর হ্যাঁ, বিয়ের পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বেঁচে থাকতে ও বাড়ি মুখো আর কোনও দিন হবো না। তোমাকে স্বচক্ষে অন্ততঃ একবার দেখার ইচ্ছে ছিল। ভগবানের আশীর্বাদে সে ইচ্ছেও আজ পূর্ণ হল।
রূপসা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, অনীশের গালে হালকা স্পর্শ করে হন হন করে স্টেশনের জনসমাগমে মিলিয়ে গেল।
একি স্বপ্ন না বাস্তব।
বেশ কিছুক্ষণ অনীশের কোনও হুঁশ ছিল না।
ভাবলেশহীন, পাথরের মত নির্বাক গালে হাত দিয়ে বসে থাকল। রূপসার কোমল স্পর্শ, এক মস্ত বড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ঠিক কতক্ষণ এভাবেই বসে ছিল তার কোনও হুঁশ ছিল না।
"অনুগ্রহ করে শুনবেন. ........... ..এক্সপ্রেস কিছুক্ষণের মধ্যে এক নম্বর প্লাটফর্মে আসবে....."
ট্রেনটি এলো এবং চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম থেকে চলে গেল।
অনীশ সেভাবেই বসেই থাকল।