হিমালয়ান ভায়াগ্রা – ইয়ার্সা গুম্বা/ কিরা-জরি

এডমিন
0
ভুমিকা: শুঁয়াপোকার মতো দেখতে একধরণের উদ্ভিদ "ইয়ার্সা গুম্বা/ কিরা-জরি", যা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস নামেও পরিচিত। জীবন্ত অবস্থায় একটি পরজীবী প্রাণী ও মৃত অবস্থায় ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ। দাম কত হতে পারে? কিলো প্রতি এক হাজার, দু হাজার, দশ হাজার,এক লাখ না দশ লাখ টাকা? গবেষকরা জানিয়েছেন, চীনের বেইজিং ও হংকংয়ে এর সর্বোচ্চ মূল্য মাঝেমধ্যে সোনার দামের চেয়ে প্রায় দুগুণ ওঠে অর্থাৎ বর্তমানে এক কেজি সোনার বাজার দর প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা তার চেয়েও বেশি। মার্কিন জার্নাল ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই ‘কিরা জরি’ সারা পৃথিবীর সব থেকে দামী জৈব পণ্য। বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতভূমিতে চিকিত্‍‌সায় ব্যবহার করা হয় এই ছত্রাক৷ ভারত ছাড়াও চিন, নেপাল, ভুটানে বহু প্রাচীনকাল থেকেই জনপ্রিয় ওষুধ এই ইয়ার্সা গুম্বা।





কোথায় পাওয়া যায়:  সারা পৃথিবীর মধ্যে এই ছত্রাক পাওয়া যায় শুধু হিমালয়েই। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে সাড়ে ১১ হাজার ফুট উপরে  বিশেষ করে ভারত,নেপাল ও তিব্বতের সীমান্ত লাগোয়া হিমালয়েই জন্মায় এই ছত্রাক।

নামকরণ : উত্তরাখণ্ডের গঢ়বাল, কুমায়ুন ও হিমাচল প্রদেশের লাহুলস্পিতিতে স্থানীয় মানুষ এই বিস্ময় ছত্রাককে ‘কিরা জরি’ নামে পরিচিত। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ওফিওকরডিসেপস সাইনেনসিস। তিব্বতীরা আবার এই দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির ছত্রাককে ডাকেন ‘ইয়ার্সা গুম্বা’ নামে। বলা হয়, অবিশ্বাস্য এই ওষুধ খেলে শরীরে একেবারে রোগমুক্ত হয়ে যায়।

গরম জল, চা,স্যুপ অথবা স্টু-এর সঙ্গে এই কিরা জরি মিশিয়ে খেলে তা সারিয়ে ফেলতে পারে ক্যানসার থেকে বন্ধ্যাত্ব। এই ছত্রাক যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করে, এমনটাই বিশ্বাস অনেকের।মূলত এই কারণেই সারা পৃথিবীতে এই ছত্রাকের বিপুল চাহিদা।

ইয়ার্সা গুম্বা/ কিরা-জরির জন্মের সংক্ষিপ্ত তথ্য :  এটি একটি ইরগট প্রজাতির পরজীবী ফাঙ্গাস। এর  জীবন চক্র খুবই সল্পস্থায়ী। শীতকালে এটি একটি  কর্ডিসেপ্ট মথ,  ডিম পাড়ে ও সেই ডিম  শুঁয়োপোকার মথ রূপ ধারণ করে মাটির নিচে প্রবেশ করে। থিটারডেস নামে সেই শুঁয়োপোকার মথ প্রায় পাঁচ বছর মাটির নীচে থাকে পরে লার্ভার রুপ নেয়। লার্ভা অবস্থায় অপথিওকরডিসাইপিটাসেস (Ophiocordycipitaceae) নামক এক ধরণের ফাঙ্গাস বা ছত্রাক সেই লার্ভাকে আক্রমণ করে  এবং পুরো লার্ভাকে  নিজের শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। লার্ভার সমস্ত শক্তি শুষে নেয় এবং লার্ভার মৃত্যু হয়। তারপরে যখন ঠাণ্ডা একটু কমে আসে, মাটির উপর মশরুমের মত এক টুকরো গজিয়ে ওঠে। যেমন যেমন বরফ গলে ইয়ার্সা গুম্বা বড় হতে থাকে।

এর বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। শীতের সময় এর তাপমাত্রা থাকতে হয় হিমাংকের নিচে। তবে সেখানকার মাটিতে বিদ্যমান পানি যেন স্থায়ীভাবে জমে না যায় অর্থাৎ নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, নির্দিষ্ট আর্দ্রতা, রোদ এবং আরও বেশ কয়েকটি সূচকের সঠিক মেলবন্ধন হলে তবেই জন্ম নেয় এই ছত্রাক।

বিশেষ ভাবে উল্লেখনীয় শীতকালে এটি দেখতে ঠিক শুয়োপোকার মত একটি প্রাণী আর মে মাসের দিকে ছত্রাকে রূপান্তরিত হয়। এই ছত্রাকের দুটি ভাগ, এক ভাগ থাকে মাটির নিচে শুয়োপোকার মত দেখতে ও আরেকটি ভাগ ছোট্ট পাতলা ডগা মত মশরুম, মাটির উপরে থাকে। জঙ্গলের ঝোপঝাড়, গুল্ম, পাতা, গাছ ইত্যাদির ভিড়ে সেই ছোট্ট মশরুমের অংশ দেখেই বুঝতে হয় কিরা-জরির উপস্থিতি এবং খুব সাবধানে মাটি খুঁড়ে বের করতে হয় যা মোটেও সহজলভ্য নয়। প্রথম অবস্থায় ছত্রাকটি ধবধবে সাদা রঙের হয়, পরবর্তীতে সোনালী রূপ ধারণ করে। ইয়ার্সা গুম্বা ফাঙ্গাসটি কোণ-আকৃতির, লম্বায় প্রায় ২ ইঞ্চি ও স্বাদে মিষ্টি।      
ভারতে কোথায় পাওয়া যায়: কর্মসূত্রে প্রায় ছয় মাস যাবৎ উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন মন্ডলের পিথরাগড় জেলার ধারচুলা নামক স্থানে রয়েছি। এখানে আসার পর ছত্রাকটি নিয়ে বহু আলোচনা শুনেছি এবং ধীরে ধীরে আরও কৌতূহল ও উৎসাহ জাগে। এই বিষয়ে বহু স্থানীয় লোকের সাথে আলাপ আলোচনা করে, বহু তথ্য জানতে পেরেছি। ধারচুলা থেকে আরও 50 কিমি দূরে সোবলা নামক এলাকা থেকে শুরু হয় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা যেমন ব্রমহ পর্বত, ওম পর্বত, নন্দা দেবী , ছোট কৈলাস, আদি কৈলাস, দরমা ভ্যালি ইত্যাদি থেকে তিব্বত সীমান্ত পর্যন্ত এবং এই অঞ্চলেই দুস্প্রাপ্য কিরা জরির উপস্থিতি। এই সমস্ত এলাকা অক্টোবর মাসের পর থেকেই বরফে ঢেকে যায়। স্থানীয় এলাকাবাসী এই সময় ধারচুলাতে চলে আসেন। পুনরায় এপ্রিল মাসের দিকে নিজের নিজের এলাকায় ফিরে যান। অবশ্য কিছু লোক ওই এলাকা ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে ধারচুলাতে বসবাস করেন। মে ও জুন মাসে এটি সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ে চলে যায় স্থানীয়রা। তবে এতো উচ্চতায় কাজ করা তাদের জীবনের জন্য হুমকি। প্রচণ্ড ঠাণ্ড, বৃষ্টিতে আবার কখনো তুষার ঝড়ের কবলে পড়তে হয়, যা খুবই ভয়ঙ্কর। লোকমুখে বহু মানুষের মৃত্যুর খবরও শোনা যায়।

বিশেষ নিয়মও আছে-সাধারণত অন্য এলাকার মানুষের সেই এলাকায় যাওয়া নিষেধ। নিজের নিজের নির্ধারিত জমিতেই খুঁজতে হয়।  এই নিয়ে লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে। কিরা-জরির ওপর ভিত্তি করে কয়েক হাজার মানুষের উপার্জন বা জীবন-জীবিকা নির্ভর করে এবং এই ঔষধি সংগ্রহ করেই বেঁচে আছেন।

বাজার দর : মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ধারচুলা আশেপাশে নগদ টাকার অকাল দেখা দেয়, ব্যাঙ্কে বিশাল ভিড় তবুও মাসে 2 হাজার মাত্র 2 বার টাকা পাওয়া যায়। শোনা যায় হেলিকপ্টারে করে ক্রেতা পিথরাগড়/হলদ্বানী থেকে আসেন। চোরাপথে আকাশছোঁয়া দামে মেলে এই ছত্রাক। এই বছর ২০১৮ তে ধারচুলা বাজারে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। একটি ছত্রাকের দাম প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। স্থানীয় সূত্র অনুসার এই এলাকায় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ছত্রাক সংগ্রহ করা হয় যার স্থানীয় বাজার মূল্য প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকা।

বিলুপ্তির পথে ইয়ার্সা গুম্বা : আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যাধিক চাহিদা ও অর্থের লোভে মানুষ বেশি বেশি মাত্রায় কিরা-জরির সংগ্রহ করার কারণে বিলুপ্ত হওয়ার পথে বা ঝুঁকিতে রয়েছে ‘ইয়ার্সা গুম্বা’। তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং কেও বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন। আগে প্রতিদিন একশটির মতো পাওয়া যেত। এই বছর সংখ্যা প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ টিতে নেমে এসেছে।

উপযোগিতা: সনাতনী চিকিৎসকদের মতে এর মাধ্যমে পুরুষত্বহীনতা, অ্যাজমা এবং ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়।এই ছত্রাকটিকে পুরুষের শুক্রাণু বৃদ্ধির কাজে,ঘাড়,বুক-কোমরের ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ফুসফুসে সংক্রমণ, যে কোনো  ব্যাথা, রক্তকল্পতা ও আরও অগুনিত রোগের ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সমাপ্তি : চির যৌবন ধরে রাখতে, শুক্রাণু বৃদ্ধি ও শক্তিবর্ধক হিসেবে এই ঔষধি দেশ ও বিদেশে খুবই জনপ্রিয় এবং হিমালয়ান ভায়াগ্রা নামেই সুপরিচিত।

সূত্র ও তথ্য সহযোগিতা : শ্রী সুরিন্দর ধামী, শ্রী চঞ্চল গার্বিয়াল, শ্রী সন্তোষ চুগিয়াল,  শ্রী নবীন জোশী(সকলেই কিরা-জরি সংগ্রহকারী), শ্রী মোহাম্মদ শাহদাব (ক্রেতা) ও আরও অনেকে- ধারচুলা এবং অধিকারী - রঙ(ভুটিয়া) মিউজিয়াম, ধারচুলা।


ছবি সৌজন্যে: শ্রী সুরিন্দর ধামী, ধারচুলা।
স্বত্ত সংরক্ষিত - @এম ওয়াসিক আলি . 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !