বন্ধ্যত্ব – এক অভিশপ্ত নারীর গাথা
যুগ যুগ ধরে আমরা শুনে আসছি – মেয়ে মাত্রই পরধন। প্রাকৃতিক নিয়মে যার জন্ম, লালন-পালন, শিক্ষা দীক্ষা সব কিছুই পিতৃকুলে। কিন্তু বিয়ের পরই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে স্বামীর হাত ধরে গৃহ ত্যাগ। বিবাহ–মেয়েদের জীবনের চরম সত্য। মা-বাবা জন্মের পর থেকেই মেয়েকে আগলে রাখেন পাখির বাচ্চার মতো আর সেই মেয়ে একদিন কোকিলের বাচ্চার মত সব মায়া মমতা ত্যাগ পরগৃহে চলে যায় ।
একদিন হঠাৎ করেই ২৪ বছরের অনিতার বিবাহ খুব ধুম ধামের সাথে সুসম্পন্ন হল। বাড়ি সুদ্ধ সকল লোক জনকে কাঁদিয়ে, নিজে বিনা অশ্রু বর্ষণ করে হাসতে হাসতে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে গেল। উপস্থিত সমস্ত আত্মীয়স্বজন অবাক হয়েছিল অনিতার এহেন আচরণে। সকলেই অবাক! কারও কিছুই বোধগম্য হল না।
পাত্র অনিতার কলেজের সিনিয়র। কলেজের সোনালি দিনগুলিতে অনিমেষকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। ভালোলাগা ছিল, কিন্তু প্রেম? না সে কোনও দিনই ভাবে নি সে বিষয়ে। কিন্তু অনিমেষ কলেজ জীবনে কোনও দিনই অনিতাকে লক্ষ করে নি। ভাগ্যের কি খেল!সেই ভালোলাগার পাত্রের সাথেই রীতিমতো দেখাশোনা করেই বিয়ে সুসম্পন্ন হল। অনিতা খুব খুশী।
অনিতা কথাগুলো প্রথম দিকে কাউকে জানায় নি, বিয়ের প্রায় মাস খানেক পরে সমস্ত ঘটনাবলি গুলো জেনে অনিমেষ খুব হেসেছিল এবং অনিমেষই অনিতার বাপের বাড়িতে সকলের সামনে হাঁড়ি ভেঙেছিল। অনিতার খুব রাগ হচ্ছিল, কেনই বা বোকার মত সব কিছু অনিমেষকে বলতে গেল।
বিয়ের পর হাসতে খেলতে তিন তিনটি বছর অতিক্রান্ত হল। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসার কোনও খামতি ছিল না। একদিন সমাজের অলিখিত নিয়মে তারা মহা ফাঁফরে পড়ে গেল।
অতি বাস্তব প্রশ্নের সম্মুখীন। বাচ্চা-কাচ্চা কবে হবে বৌমা?
আমি কি নাতিপুতির মুখ না দেখেই কি চলে যাবো? ইত্যাদি ইত্যাদি...।
বিষয়টি নিয়ে তারা সেভাবে কিছুই ভাবে নি সুতরাং উভয়েই ভেবে দেখল এটাই বাচ্চা নেবার সব থেকে উপযুক্ত বয়স। সন্তানকে লালন পালন করার লোকের অভাব হবে না। সাতপাঁচ আর না ভেবে সম্মিলিত ভাবে বাচ্চার নেওয়ার সিদ্ধান্তে নিল।
ইতিমধ্যে অফিসে অনিমেষের প্রমোশন হয়েছে, এখন সে অফিসের বস। কাজের পরিধিও এক লাফে অনেকখানি বেড়ে গেছে, ব্যস্ততাও বেড়েছে ।
কিন্তু তারপরও পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে অনিতার গর্ভে সন্তানের দেখা নেই। বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাটছিল। সমাজ, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন বানে অনিতার হৃদয় ছিন্ন ভিন্ন । সে বুঝতে পারছে কেমন যেন খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে, ছোট খাটো বিষয়ে রেগে যাচ্ছে।
অনিতার মনে বারবার একটা প্রশ্ন জাগে, সে কি একাকী দায়ী সন্তান না জন্মানোর জন্য? কই অনিমেষকে কে তো কোন রকমের প্রশ্নের সামনা সামনি হতে হয় না। শাশুড়ি তো একবার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পান না। অথচ কোনও কিছুই তার কাছে লুকিয়ে নেই। ইদানীং আর রাতে ঠিক মত ঘুম আসে না, মাঝে মাঝে সারা রাত জেগেই কেটে যায়। এই বিষয়ে অনিমেষের সাথে আলোচনা করার কথা প্রায়ই ভাবে,যদি কোনও Psychologistকে দেখানোর প্রয়োজন হয়। অন্তত: ওষুধ পত্র গিলে যদি ঘুম আসে।
কিন্তু সকালের নিত্য ব্যস্ততা আর দের রাত করে ফেরা অনিমেষের মুখের দিকে চেয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না বলবে কি না? হয়তো সে সন্তানের সুখ থেকে বঞ্চিত থেকেই যাবে, কি জানি অদৃষ্টে কি লেখা আছে ?
অনিমেষ অফিস বেরোনোর পর কাজ কর্ম আর সে রকম থাকে না, শ্বশুর শাশুড়ি দুপুরের আগে আর কিছুই মুখে দেন না। এই সময়টা অনিতাকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে খায়, শুধ ভাবতে থাকে বাঁঝ(সন্তানহীনতা) অপবাদ নিয়ে কি সে পৃথিবী থেকে চলে যাবে? বিবাহিতার শূন্য কোল বর্তমান যুগে এক মহা অভিশাপ কথাটা সে খুব ভাল করে বুঝতে পারে।
সন্তান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এক মজবুত সেতুবন্ধন, দাম্পত্য সম্পর্ক তাতে পূর্ণতা পায়। কিন্তু বন্ধ্যত্বকে বলা হয় দাম্পত্য জীবনের অভিশাপ । কোন দম্পতির শখ হয় না শিশু সন্তানের হাসি দেখার? কিন্তু বহু চেষ্টার পরেও অনিতা অনিমেষকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারে নি।
অনিমেষের এতো ভয়ের কারণ কি?
তার কি কোনও সমস্যা আছে?
কিছুতেই বুঝতে পারে না। অন্তত: একবার ডাক্তারের কাছে গেলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এভাবেই ১০ বছর কেটে গেল, আশ্চর্য অনিমেষের দিক থেকে কোনও রকমের সহযোগিতা পেল না। বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একটা Infertility ক্লিনিক খুলেছে, ডাক্তার পাড়ারই এক কাকু, ক্লিনিক খুব রমরমিয়ে চলছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা । একজন পরিচিতের কাছে শুনেছে সে চিকিৎসা খুব কষ্টের, তবুও সন্তানের আশায় সে বিষ পান করতেও রাজি। তা ছাড়া দত্তক নেওয়ার ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা করতে পারে, কিন্তু আজকাল সবকিছুতেই অনিমেষের অনীহা!
অনিতা এখন শুধুমাত্র চমৎকারের অপেক্ষায়। একমাত্র ভগবানই সহায়। তাঁর কৃপা ও আশীর্বাদে যদি সন্তানের সুখ পায়।
কিন্তু তার জীবনে আমূল পরিবর্তন আসবে? একটি নবজাতকের কান্নার অর্থ কি, সে মূল্যায়ন করা তার মতো বাঁঝের (?) দ্বারা সম্ভব? সে জানে নবজাতকের কান্না মায়ের মুখে স্বর্গীয় হাসি ফোটাতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বা গভীরে অনুভব না করলে তার সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না।
অনেকক্ষণ হল অনিতা বিছানায়, মাঝ রাত পেরিয়ে রাতের চাঁদের জৌলুষ ক্রমশই ফিকে। এখনও অনিতার দুচোখে ঘুমের দেখা নেই, কখন যে আসবে সেও জানে না !
ভেজা বালিশটা পাশে রেখে অনিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশে উচ্চসুরে অনিমেষের নাসিকা গর্জন চলছে।