এ কেমন মল্লিকা তুমি

এডমিন
0
এ কেমন মল্লিকা তুমি - #এম_ওয়াসিক_আলি


মল্লিকা বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত চঞ্চলা, তার দুষ্টুমিতে বাড়িশুদ্ধ লোক অস্থির, সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতো, কখন যে কার পেছনে লাগে। মা যথারীতি শাসন করার চেষ্টা করতেন কিন্তু তার কথা শুনে কে?
বাড়িতে মজা-মস্তিতে মন না ভরলে পাড়া প্রতিবেশী আন্টি-চাচী, কাকিমাদের পালা। বয়স্কদেরও ছাড় ছিল না। ক্রমাগত নালিশে মায়ের কান ঝালাপালা হয়ে উঠত। মাঝে মাঝে একটু আধটু বোঝানোর চেষ্টা। দেখ মা তোর বয়স বাড়ছে, আর তুই এখনও ধিরিঙ্গিপনা করে বেড়াবি, কে তোকে বিয়ে করবে!!! একটু আমাদের কথা ভাব মা। একটু পড়াশুনায় মন দে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মা তোমার এই অযথা বাবা-জ্ঞান দান আমার মোটেও পছন্দ নয় আর পড়াশুনা করে কি হবে? তুমি তো বি-এ পাশ কি করেছো! মল্লিকার উত্তর হামেশা তৈরি।
উপায়হীন মা রণে ভঙ্গ দিয়ে হেঁসেলের কাজে মনোনিবেশ করাই শ্রেয় ভেবে চুপ করে যেতেন। বেরিয়ে আসতো এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস। হে ভগবান তুমিই রক্ষা করো, কি যে হবে এই ধিরিঙ্গি মেয়ের!!
কিন্তু অবিশ্বাস করার উপায় নেই একদিনের জন্যও মল্লিকার শরীর খারাপ হলে বা বাড়ির বাইরে না গেলে , পাড়াশুদ্ধ নির্যাতিতাদের বাড়িতে ভিড় জমে যেত, বাবা শুধু মুচকি হেসে বলতেন দেখলে তো মল্লিকার মা তোমার মেয়ের গুণ আর জনপ্রিয়তা।
মা ঝাঁঝিয়ে উঠত, তোমারই তো লাই পেয়ে মাথায় উঠে নাচছে। আমার কথা না শুনলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে আমাদের বলে রাখছি মিলিয়ে নিও। বাবা শুধু মনে মনে হাসতেন। উল্টে মল্লিকার হয়ে মাকে দু চারটে কড়া কথা শুনিয়ে ছাড়তেন। এভাবেই কখন যে মল্লিকা 22 বছরে পা রাখলো কেউ ঢের পেল না। কোনও রকমে টেনেটুনে বি-এ করেই এত খুশি যেন পৃথিবীর সব মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের পেছনে ফেলে একাই পাশ করেছে।
একদিন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বিশেষ কাজে মল্লিকার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এমনিতে মল্লিকা গুরুজনদের সামনে আসে না, কিন্তু মায়ের জুরাজুরিতে মল্লিকাকে বাধ্য হয়ে আগন্তুকের পা ছুতে হল। বাবা পরিচয় করে দিলেন আমার মেয়ে মল্লিকা। আমাদের সকলের নয়নের মণি।
বাবার কথা শুনে মল্লিকা খিলখিল করে হেসে উঠল। মল্লিকা লক্ষ্য করল ভদ্রলোকের চোখের ভাষা কিন্তু একদমই বদলে গেছে। মল্লিকার দিকে পলকহীন চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ।
কথায় বলে "যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়"। মল্লিকাও কথাটা জানতো, কিন্তু এই প্রবাক্য তার জীবনে মিলে যাবে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। মা-বাবা ও দাদা বিয়ের কথা বললেই মল্লিকা ক্ষেপে যেত, রাগ গিয়ে পড়ত, নিরীহ বাসনপত্রগুলোর উপর। কত যে বাসনপত্র শহীদ হয়েছে ইয়াত্তা নেই।

বাবার বন্ধু ঠিক ওঠার সময় কথাটি পাড়লেন। উনি চলে যাওয়ার পর মা-বাবা দীর্ঘক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করলেন। মা বেশ উৎফুল্ল ও আগ্রহের সাথে শুনছিল। মল্লিকা মনে মনে প্রমাদ গুনছিল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, খুব ভালো ছেলে, বাবা নিজেও ছেলেকে চেনে-জানে, খুব আজ্ঞাকারী, সুন্দর, সুদর্শন ইত্যাদি ইত্যাদি, সব থেকে বড় কথা ছেলে সদ্য বিডিওর চাকরিতে যোগ দিয়েছে। ছেলের গুণগান শুনতে শুনতে মল্লিকার কান ঝালাপালা হয়ে উঠল।সহজেই বুঝতে পারল এ যাত্রা রক্ষা পাওয়া খুব মুশকিল।
যথারীতি বিয়ের হাত থেকে বাঁচতে নতুন ফিকির খুঁজতে লাগল। গভীর রাত পর্যন্ত চিন্তা ভাবনা করে একটি বুদ্ধি বের করল, পরদিন সকালে মা পুনরায় বিয়ের কথা তুললে মল্লিকা একটি শর্ত রাখল, সে পাত্রকে একবার দেখতে চাই এবং পাত্রের বাড়ি গিয়ে। এমন উদ্ভট শর্তে বাবা একটু চিন্তিত হয়ে গেলেন, কি জানি পাত্রপক্ষ বিষয়টি কি ভাবে গ্রহণ করবে, ব্যাপারটা বন্ধুর সাথে আলোচনা করলেন। বাবার বন্ধুও প্রস্তাব পেয়ে খুব খুশি, বললেন বেশ তো!!
যথারীতি পাত্র-পাত্রী একে অপরকে পছন্দ করল এবং শুভমুহূর্ত দেখে খুব ধুমধামের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হল। আশ্চর্য বিদায় লগ্নে মল্লিকা ছাড়া, বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশী সকলের চোখে জল। সকলকে কাঁদিয়ে নিষ্টুর হয়ে শশুর বাড়ী চলে গেল।
বৌমাকে পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সকলেই খুব খুশি। মল্লিকাও খুশি, কি ভাবে যে দু দিন কেটে গেল কিছুই বুঝতে পারলো না, এই দুদিনে স্বামীর সাথে বিশেষ কথাবার্তাও হল না। বিয়ের দু দিন পর এক মাসতুতো দাদা নিতে এলো। মল্লিকাও খুশি খুশি বাপের বাড়ি চলে গেল। এভাবেই তার বাপের বাড়িতে যাতায়াত লেগেই থাকলো। কিন্তু স্বামীর সাথে এখনও মনের মিল হল না, মল্লিকা সব সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ঘেরাটোপে ব্যস্ত, স্বামীও ব্যস্ত, সেই সকাল 8 টায় বেড়িয়ে রাত্রি 7 টায় বাড়ি ফেরে। বিয়ের পরেও মল্লিকার বচপনা গেল না, ছোট ছোট বিষয়ে রাগ করে, বেচারা স্বামী!!
একদিন এমনি দু জনের মধ্যে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডা চলছিল, অবশ্য ঝগড়া নয়, তর্কবিতর্ক মাত্র। কথায় কথায় অনীশ বলল তুমি আমাকে অনেক ভালবাসো জানি কিন্তু মুখে আনতে তোমার লজ্জা পায়।
মল্লিকা মুচকি হেসে বলল , আহা মরণ, ও সব আমার দ্বারা হবে না। 
অনীশ বলল, তাই?
মল্লিকার জবাব , জী হ্যাঁ!!!
যদি ভালো না বাসো তবে বাপের বাড়িতে মন কেন লাগেনা?
মল্লিকা প্রমাদ গুনল, কথাটা একদম ফেলনা নয়, শ্বশুরবাড়িতে সে আলাদা গুরুত্ব পায় এবং সে উপভোগ করে, কিন্ত এখনও মনে প্রাণে অনীশের
হয়ে গেছে বললে ভুল হবে। কিন্তু মজা করে বলল, বয়েই গেছে আমার, মিস্টার এমন কল্পনা করা ছেড়ে দিন।

অনীশ শান্তসুরে বলল, ঠিক আছে, এরপর বাপের বাড়ি গিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আসার সিগন্যাল না দিই , আসবে না, যদি চলে এসো তবে ভাববো, তুমি হেরে গেলে।
চ্যালেঞ্জ করো না, হেরে যাবে।আচ্ছা শুনি তুমি কি ভাবে সিগন্যাল দেবে? মল্লিকা দুষ্টমির সুরে বলল।
অনীশ মজা করে বলল-একটা সাদা কাগজ দেখলেই বুঝবে আমি তোমাকে মিস করছি, নইলে তুমি বুঝে নিও..... ।
মল্লিকা কেমন যেন গুম হয়ে গেল, কাকতলীয় ভাবে সেদিনই মল্লিকার বাবা সন্ধ্যা বেলায় হাজির। চা পান পর্ব শেষ হওয়ার পর বেহানকে কে অনুরোধ করলেন , মল্লিকাকে সাথে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।মল্লিকার শাশুড়ি হাসি মুখে বলল আপনি না বললেও পাঠিয়ে দিতাম।
সকলেই হাহাহাহাহা করে হেসে উঠল।
প্রথম 2 দিন বাপের বাড়িতে মল্লিকার বেশ মজার সাথে কাটল। পাড়া প্রতিবেশী , আত্মীয় স্বজন কেউ জামাই কেমন জিজ্ঞেসা করলে, মল্লিকার সটান উত্তর, একটু বোকা, একটু ন্যাকা আর মাথায় ছিট আছে। মা অমনি রেগে কি!!! দেখো মেয়ের মুখে কি কথার ছিরি!!
কিন্তু হপ্তা খানেক পর শশুর বাড়ীর জন্য মন খারাপ করতে লাগল, কিন্তু মুখ ফুটে বলাও যায় না, সব কিছুই ঠিক আগের মতোই , তবুও এ বাড়ি কেমন যেন পর-পর লাগতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে মল্লিকার ছোট্ট ছোট্ট অধিকার গুলো আর এ বাড়িতে নেই।
দিন দশেক পর, মল্লিকার শশুর নিতে এলেন, ঠাট্টার সুরেই বললেন চল মা, সকাল সকাল তোর হাতের চা না খেলে আর ভালো লাগে না। বাড়ি শুদ্ধ সবাই অপেক্ষা করছে।
মল্লিকা লজ্জিত হয়ে বলল, বাবা আরও কিছুদিন থাকি না!!মল্লিকার কথা ভেবে শশুরমশাই রাজি হয়ে গেলেন।
কিছুদিন পর একমাত্র ননদ দেখতে এল। বাপের বাড়িতে মল্লিকার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, মনে মনে চাইছিল কেউ এসে সসম্মানে নিয়ে যাক। ননদকে দেখে খুব খুশি। ননদও নিয়ে যেতেই এসেছে। সারাটাদিন হাসি-ঠাট্টা, হৈ-হুল্লোড়ে কেটে গেল, এদিকে যাওয়ার সময় নিকটে, ব্যাগপত্রও রেডি কিন্তু মল্লিকা কোনও সিগন্যাল পাচ্ছে না। অগত্যা মায়ের কাছে শরীর খারাপের বাহানা করে, না যাওয়ার জেদ ধরল। সকলেই বোঝানোর চেষ্টা করল যে এবার না গেলে ওর শ্বশুরবাড়ির লোক খারাপ ভাববে, কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে গেল। ক্ষুণ্নমনে ননদ একাই ফিরে গেল।
এদিকে মল্লিকা শ্বশুরবাড়ি না আসায় বেশ চর্চা শুরু হয়ে গেছে । সকলেই অবাক কি সমস্যা হল? অনীশের সাথে কিছু হয়েছে নাকি? কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। ওদিকে বাপের বাড়িতেও রীতিমত যুদ্ধ শুরু, সকলেই বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মল্লিকা একরোখা, কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি যাবে না।
দুই বাড়ির লোকজনের মধ্যে জোড় আলাপ আলোচনা হল, কিন্তু কোনো সূত্র বেরোলে না। সন্ধ্যা বেলায় অনীশ বাড়িতে ফিরতেই মা সরাসরি জানতে চাইলেন, মল্লিকার সাথে ঝগড়া ঝাঁটি কিছু হয়েছে কিনা?
অনীশ বলল কি সব আজেবাজে কথা বলছ মা, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বাবা অগ্নিশর্মা, তো তুমিই বুঝিয়ে বল না বাপু। বৌমা কেন এখানে আসতে চাইছে না।
দিদি বিগত দিনের সব কথা বিস্তারিত ভাবে শোনালো। সব শুনে অনীশ হাসতে হাসতে অস্থির এবং সাদা কাগজের গল্প সকলকে শোনাল।
বাবার রাগ আরও বেড়ে গেল, দাঁত কটমট করে বলল, রসিকতা করার জায়গা পাও না! অপদার্থ কোথাকার।
অনীশ বাবার এই রূপ ধারণ আগে কখনোই দেখে নি, বৌমার টানে এই অবস্থা। মনে মনে হাসল। কাল বিলম্ব না করে সেই রাতেই মল্লিকার বাপের বাড়িতে হাজির। বাড়িতে সকলেই চিন্তিত বেহাইমশাই এই সময়? মল্লিকার মার বুক চ্যাৎ করে উঠলো। কি জানি কি বিপদ?
মল্লিকার শশুর মল্লিকাকে ডাকলেন। মল্লিকা প্রণাম করে যেই উঠেছে , তার সামনে এক সাদা কাগজ মেলে ধরলেন। কেউ কিছু বুঝতে পারলো না, কিন্তু মল্লিকা খুব লজ্জা পেল, কিছুক্ষণ পর ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির, চলুন বাবা। বাড়ি শুদ্ধ লোক অবাক, কেউ কিছুই বুঝতে পারছে। কিন্তু মল্লিকার শশুরের মুখে মুচকি হাসি। তিনিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু বৌমাকে কিছুতেই ছোট করবেন না, তাই মুখে কিছুই বললেন না।
শশুর বাড়ী পৌঁছেই মল্লিকা দৌড়ে নিজের ঘরে ছুটে গেল, অনীশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল, অনীশের গেঞ্জি ভিজে ভিজে একাকার। সেও হতভম্ব। প্রথমবারের মতো মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরার সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করছিল না।
কিছুপরে অনীশ মল্লিকার মুখ উপরে তুলে ধরতেই অবাক! একি সে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না, এ কোন মল্লিকা? এই মল্লিকাকে জীবন সাথী রূপে পাবে কল্পনার অতীত ছিল।
আর মল্লিকাও তার সঠিক জীবন সাথীকে খুঁজে পেল।
বিয়ের 25 বছর পর আজও তারা সেই সাদা কাগজের প্রসঙ্গ টেনে খিলখিলিয়ে হাসে........আর খুনসুটিতে মেতে ওঠে ।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !