ভিন্ন স্বাদের ভালোবাসা ঃ - অধূরা পলক
# পর্ব :: ১
আজ রোববার, আলসেমির দিন।
প্রায় ২টোর দিকে খাওয়া দাওয়ার পর ভাত ঘুম দিয়ে সবে মাত্র উঠেছি। গ্রীষ্মের দুপুরে খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথেই বিছানা চুম্বকের মত আকর্ষণ করে, বিশেষ করে আমাকে। ঘুম থেকে উঠেই খুব খিদে পেয়েছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটা। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই প্যাঁচপ্যাঁচে গরম। উদরের সাথে যুদ্ধে পেরে ওঠা অন্ততঃ আমার পক্ষে খুবই কঠিন।
অগত্যা ফ্রিজ থেকে একটা ডিম আর দুপুরের বেঁচে যাওয়া ভাত বের করলাম। কালো কুচকুচে ফ্রাইপ্যানে অল্প একটু তেল, দুটি সবুজ লঙ্কা ও অল্প পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ডিমের ভাঁজির সাথে ফ্রয়েড রাইসের মত কিছু একটা ফটাফট বানিয়ে ফেলি। ক্লাসের বান্ধবীরা প্রায়ই মজার ছলে বলে, ইস! তোকে পটাতে পারলে, লাইফটা একেবারে সেট হয়ে যেতো। আর বন্ধুরা, খুব হিংসে করে বলে, তোর বৌয়ের কপাল খুব ভালো হবে রে...!! সাথে স্পেশাল খিস্তি উপরিপাওনা। একটু আধটু রান্নার সাথে কিসের এত আদিখ্যেতা বুঝি না।
গত বছর ঘুরতে গিয়ে কেরল থেকে ২৫০ গ্রাম মত প্রিমিয়াম কফি এনেছিলাম, গার্ডেন ফ্রেশ।এককাপ গরম জলে অল্প একটু কফি, ব্যাস কেল্লা ফতে, তৈরি প্রিমিয়াম ব্ল্যাক কফি, সাথে গরমা গরম শাহী ফ্রয়েড রাইস.. আহা....! মগন ছিলাম সৃষ্টকে নিয়ে, হঠাৎ দেখি রান্নাঘরে শেষ বিকেলের ছটায় এক প্রতিছায়া, চোখ পড়তেই চকিতে সরে গেল। একটু খটকা লাগল, কে আবার এমন উৎসুক? কৈ আগে তো দেখিনি?
ধ্যাৎ তেরি!!
এদিকে গরমা গরম ফ্রয়েড রাইসের অবস্থা আশঙ্কাজনক, অবিশ্যি এখনও সুগন্ধে ম-ম।রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এলাম, সাত পাঁচ না ভেবে লোভনীয় ফ্রয়েড রাইসে মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ দেখি আবার সেই ছায়া, দিব্যি তাথৈ তাথৈ করছে, কোনোরকমে গোগ্রাসে গিলে ফেললাম, মগজে শার্লক হোমসের আত্বা কিলবিল করতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে ব্যাপারতার গভীর পর্যন্ত যেতে হবে। ধীরে পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি,পড়ন্ত বিকেলের মায়া ত্যাগ করে সোনালী আভা সন্ধ্যার গ্রাসে। সুতরাং ছায়াও বেপাত্তা।
এক কামরার ছোট্ট একটি ফ্লাট, একা থাকি, সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বন্ধুরা রান্নার তারিফ করলেও ঘর সম্পর্কে এতটুকুও টু-টা করে না। রাত প্রায় সাড়ে ১০টা, অন্য দিন এ সময়ে ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু আজ ঘুম উধাও, চোখ বন্ধ করলেই সেই ছায়ার আবির্ভাব।
ঘুমের ঘোরে কানে টিং টং বাজছে, একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে দেখি বেলা সাড়ে নয়টা, বাহিরে কেউ অনবরত কলিং বেল টিপে যাচ্ছে। খুলে দেখি কাকু মানে এই ফ্ল্যাটের মালিক ও তাঁর ছেলে মাহিন। পেছনের গলিতে আলিশান দোতালা বাড়ি। কোলকাতা হাই কোর্টে প্র্যাক্টিস করেন মানে উকিলবাবু।
নমস্কার কাকু!!
নমস্কার, মাস্টারমশাই, কি ব্যাপার মাহিন দু দুবার এসে ঘুরে গেল, শেষে আমিই চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি সব ঠিকঠাক আছে তো?
ডাক্তারি পড়াশুনার সাথে সাথে প্রাইভেট টিউশনি, একটু আধটু উপার্জন হলে ক্ষতি কি? মাস্টারমশাই শব্দটি খুব একটা পছন্দ করি না, কিন্তু কেন জানি না, সকাল সকাল সম্বোধনটি খুব ভালো লাগল।
না কাকু কিছুই হয়নি, পড়াশোনার চাপ ছিল , তাই রাতে শুতে দেরি হয়েছে।
ওহ!! এ ব্যাপার, মাহিন তো খুব ভয় পেয়ে গেছে।
কাকু ভনিতা না করেই বললেন -- বাপু ডাক্তারি পড়া কি এত সোজা?
মাহিন, কিছু বুঝতে পারলি, পড়াশুনা কাকে বলে!!
দু এক মিনিটের মধ্যেই আরও কিছু জ্ঞানমূলক উপদেশের বন্যা বয়ে গেল। সকাল সকাল এত উপদেশ শুনে ঝিমঝিম করছে।উনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন।
আর কথাবার্তা না বাড়িয়ে বললেন...এখন তো তোমার কলেজ যাওয়ার সময়, তাই না?
জি, কাকু!!
ঠিক আছে, চল মাহিন, সন্ধ্যায় পড়তে আসিস। বলেই কাকু ও মাহিন চলে গেলেন।
মাহিন খুবই আজ্ঞাকারী। গত চার বছর যাবত আমার পার্মানেন্ট ছাত্র। ওর এক দিদি ছিল,মাইক্রো বায়োলোজি নিয়ে B.Sc(H) 1st ইয়ারে পড়ত। বছর দুয়েক আগে ক্যানসার এ মারা গেছে।ছেলেটিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি, এখন তার ক্লাস টুয়েলভ, পড়াশোনায় তুখোড়, সেও ডাক্তার হতে চাই।আমার কাছে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি পড়ে, বোর্ড পরীক্ষা শেষ, সামনেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা।
আর সাতপাঁচ না ভেবে, ফটাফট তৈরি হয়ে, কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, ব্রেকফাস্ট ক্যান্টিনে হবে।
সারাদিন মনটার তেলতেলে ভাব।
চারটার দিকে ঘরে ফিরলাম, ক্ষিদে পেয়েছে, এমন সময় ম্যাগির তুলনা নেই, বানাতে দু মিনিট থেকে বেশিই লাগে, বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করলে, মুস্কিল।
গরমা গরম চামচে ফুঁ দিয়ে মুখে তুলতে শুরু করেছি, আর সে সময়েই বেডরুমের ব্যালকনিতে ঢিল পড়ার শব্দ। পর পর দুটি, তার মানে কেউ ইচ্ছেকৃত ভাবে ঢিল ছুড়ছে, খুব বেশি কৌতূহল না দেখিয়ে ম্যাগীতে মনোনিবেশ করলাম।
একটু পরে, মাহিন হাজির, ইচ্ছে না করলেও উপায় নেই, মাহিনের বাবা খুব স্ট্রিক্ট, টিউশন ফি আদায় করার সময় গুণে গুণে কথা শোনাতে ছাড়েন না।
পাড়ার পাশাপাশি মন্দির ও মসজিদ থেকে ঘন্টা ও আজানের শব্দ একসাথে শোনাটা এখন ভালো লাগে, প্রথম প্রথম খুব বিরক্তিকর ছিল। এতএব সন্ধ্যা নেমে গেছে।
মাহিন কাল সকালে আসিস না, পরীক্ষা আছে।
ঠিক আছে স্যার, বলেই চলে গেল।
মাহিন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঢিল, এবার টুপ টাপ করে বেশ কয়েকটি।সেই ছায়া-ওয়ালি নয় তো?
ভর সন্ধ্যায় শরীরে বিদ্যুতের মত শিহরণ খেলে গেল।! সাথে অজানা আকর্ষণ। সুতরাং আর দেরি না করে পর্দা সরিয়ে দেখি কেউ কোত্থাও নেই। জানালাটি খুলে দিলাম, ভেতরে লাইট অফ করে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলাম, কে বদমাশী করছে। না আর ঢিল পড়লো না, বদলে এক টুকরো কাগজের ঢেলা এসে পড়ল। সদর্পনে এগিয়ে টুকরোটি হাতে তুলে নিলাম, কম্পিত হাতে খুলে দেখি খালি কাগজ।
মেজাজটা একেবারেই বিগড়ে গেল। খুব রাগ হল, কোথায় মোবাইল নাম্বার আশা করেছিলাম আর বদলে সাদা কাগজ!!
আগামীকাল এনাটমির ফাইনাল প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা আছে, ফেল করলে কপালে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। শেষ পরীক্ষা, এর পর শুধু ইন্টার্ন বাকি।
কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে সুজাতের মেসের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম, না এখানে পড়াশুনা করা সম্ভব নয়। পরদিন প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা শেষ করে, খুব রিলাক্স লাগছিল, প্রিয় বন্ধু সুজাতের সাথে ইভিনিং শোতে সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম, সাথে ডিনার। গত চার বছর ধরে যা ধকলটাই না গেল।
বাসায় এসে দেখি, মাহিন অপেক্ষা করছে, তার সময়ের হেরফের হওয়া খুবই কঠিন।
আয় মাহিন।
স্যার পরীক্ষা কেমন হলো?
মাহিনের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ভালো রে।
পড়া শেষে, যাওয়ার আগে মাহিন আমার দিকে তাকালো।
কিছু বলবি?
স্যার আজ মা রাতে খাওয়ার জন্য বলেছে। নয়টার দিকে চলে আসবেন। বাবাও সাড়ে আটটার মধ্যে চলে আসবে।
হঠাৎ করে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল, ঢিলের উৎস তো পেছনের দিক থেকে, মাহিনের বাড়িটাও তো আমার বেডরুমের পেছনের একটা বাড়ির পাশেই, তবে কি মাহিনের বাড়ি থেকে কেউ ঢিল ছুঁড়ছে না পাশের বাড়ির অন্য কেউ?
হঠাৎ করে রাতে খাবার নিমন্ত্রণ? সংযোগ না পূর্ব পরিকল্পিত চিত্রনাট্য। যায় হোক না কেন , সমস্যা বেশ জটিল। সুজাতকে ফোনে প্রোগ্রাম ক্যানসেল করার কথা জানালাম । সেও নাছোড়বান্দা। অন্য একদিন আর্মেনিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়ানোর শর্তে, শেষে অনেক কষ্টে রাজি হল।
এদিকে উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে......ঘন ঘন মোবাইলে সময় দেখছি, সাড়ে ছয়, সাত, সাড়ে সাত, আট, সাড়ে আট.... সময় কিছুতেই এগুচ্ছে না...।
লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। অসুখটা বেশ মারাত্মক মনে হচ্ছে!!
জিন্সের উপর টি-শার্ট গলিয়ে, হালকা ডিও মেখে দরজা খুলতে যাচ্ছি, সেই সময়ে পুনঃ ঢিল পড়ার শব্দ।
থমকে দাঁড়ালাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বেরিয়ে যাবো না ব্যালকনি খুলে দেখবো, কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না........।
# পর্ব :: ২
সাত পাঁচ আর না ভেবে বেরিয়ে পড়লাম।
কি ব্যাপার মাস্টারমশাই পাক্কা ৮ মিনিট দেরী? মশাই আপনি তো একা, অর্ধাঙ্গিনী না থাকাতেই লেট, কি জানি বাপু, পরে কি হয়!!!
মাথায় অন্য কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন সময়ে কাকুর ঠাট্টা মজাক মোটেও ভালো লাগছে না, কিন্তু কোনও উপায় নেই।
বাধ্য হয়ে বললাম, হ্যাঁ,কাকু একটু দেরী করে ফেলেছি....!
আরে না না মাস্টারমশাই একটু মজাক করছিলাম,মাহিনের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বাবার উপর বেশ রেগে গেছে।
স্যার আসুন.......!
চল....জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ড্রয়িং রুমটি সাজানো গোছানো, পরিপাট্য বেশ রুচিশীল। দুটি আধুনিক পেন্টিং সামনে টাঙানো, সোফা, পর্দা সবকিছুতেই অভিজাত্যের ছোঁয়া। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। মাহিনকে এতো দিন ধরে পড়াচ্ছি, কিন্তু প্রথমবার বাড়িতে পা রাখলাম। অবশ্য কাকিমা প্রায়ই ছেলের হাতে এটা ওটা পাঠাতে থাকেন।
নমস্কার কাকিমা!!
নমস্কার,নমস্কার!! বসে পড়ো অনিশ, দাঁড়িয়ে কেন!!
কাকিমা রাখঢাক না করেই বললেন, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী, কি জানি আর কোনদিন তোমার সাথে দেখা হবে কি না জানিনা, মাহিন এই দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে চাইছিল। এমনিতে আজ পর্যন্ত কোনদিনই সেলিব্রেট করিনি, মাহিনের কথা ফেলতে পারলাম না।কাকু ও কাকিমাকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানালাম। মাহিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিরে তুই তো কিছুই বলিস নি? খালি হাতে এসেছি। খুব লজ্জা করছিল। কাকিমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, তুমি তো আমার ছেলের মতো, তুমি গিফ্ট শিফট আনতে যাবে কোন দুঃখে!! মাহিনকে যেভাবে যত্ন করে, নিজের মতো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছো, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো গিফ্ট।
মাস্টারমশাই এসো, খাবার খেতে খেতে বাকি কথা হবে। কাকিমা প্রতিটি পদ অসাধারণ রেঁধেছেন, এমন সুস্বাদু খাবার কোনোদিনই খায়নি। খুব সাধারণ ঘরে জন্ম, সম্বল বলতে মাটির কুঁড়ে ঘর আর বাবার ছোট্ট মুদি খানার দোকান। সেই ছোট্ট বেলায় মা গত হয়েছেন, বাবা আর বিয়ে থা করেন নি, তাঁর হাতের কাঁচাপাকা রান্না খেয়ে বড় হয়েছি, তার পর চার বছর ধরে বাইরে। বাবার কাছেই রান্নাবান্নায় হাতেখড়ি। বাবার বি:স্বাদ রান্না থেকে বাঁচতে অগত্যা রান্না বান্না করা শিখে গেলাম।
কি বাবা ঠিক মতো খাচ্ছ না? না কাকিমা আপনি ব্যস্ত হবেন না, সব কিছুই তো খেলাম।
মাথার মধ্যে ঢিল রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে, এর মধ্যে খাবারে মনোসংযোগ করা খুব মুশকিল। এ বাড়িতে তো ঢিল-ওয়ালির অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না, নিশ্চিৎ পরের দুটি বাড়ির মধ্যেই রহস্যের উৎস লুকিয়ে আছে।
বাড়ি ফিরতে রাত দশটা, ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি দলা পাকানো এক টুকরো কাগজ। কম্পিত হাতে তুলে নিলাম, তর সইছিল না, ঘরের ভেতর ঢুকে কাঁপতে কাঁপতে খুলে দেখি এক টুকরো পাথর, আর কিচ্ছু নেই। মনক্ষুণ্ণ হলাম, কি আশা করেছিলাম আর কি পেলাম!! সে রাতে আর ঠিক মতো ঘুম এলো না। আমার মন প্রেমে মজেছে, বুঝতে পারছি। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি জানি না, কলিং বেলের টিং টং শব্দে ঘুম ভাঙল, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখি মাহিন, পড়তে এসেছে। তার মানে সাতটা বেজে গেছে।
মাহিনকে কিছু টাস্ক দিয়ে ব্যালকনিতে এলাম, এক কোণে আরও এক কাগজের দলা, এদিক ওদিক ঠিক মত দেখলাম, কেউ কোথাও নেই, অবিশ্যি লুকিয়ে নজরদারি করলে বোঝা মুশকিল। কোনোরকমে ওয়াশরুমে এসে দলাটি খুলে ফেললাম, দেখি এক টুকরো পাথর আর পেন্সিলে স্মাইলি আঁকা।
ছায়া-ওয়ালির উপর খুব রাগ হল, বংশীতে মাছ ফেঁসে গেলে যে ভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে উপভোগ করে, সেও মনে হচ্ছে লুকোচুরির খেলা খেলছে। সব রাগ গিয়ে পড়ল বেচারা মগটির উপর, মগের আর্তনাদ শুনে মাহিন ছুটে এসে বাথরুমের দরজায় টোকা দিল।
স্যার, স্যার ....পড়ে গেছেন নাকি?
ছিঃ ছিঃ, মাহিনের সামনে বেইজ্জতি। শান্তসুরে বললাম, না রে..মগটা পড়ে গেছে।
ও!! আচ্ছা, বলে মাহিন চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে, মাহিনকে জিগ্যেস করলাম, চা খাবি?
না স্যার , আমার ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেছে, আপনি খান।
মাহিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনার মন, শরীর ঠিক আছে তো?
হেঁসে বললাম - কেন? তোর কিছু মনে হচ্ছে নাকি?
না কাল থেকে দেখছি আপনি একটু অন্যমনস্ক, অন্যমনস্ক।
নারে কাল এনিভার্সারী ছিল, তোর আগে বলা উচিৎ ছিল, খারাপ লাগছিল, কেউ খালি হাতে যায় নাকি?
মাহিন লজ্জায় মুখ নিচু করে বলল- মা নিষেধ করেছিল।
কাগজ পর্ব কোনরকমে ম্যানেজ করলাম। নিজের উপর ঘেন্না করছে, মাহিনও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, বাকিটা জানতে পারলে কি ভাববে কি জানি!!
আসছি স্যার, বলে মাহিন বেরিয়ে গেল, আনমনে মাহিনের চলে যাওয়া দেখতে থাকলাম।
# পর্ব :: ৩
কলেজে গিয়ে সুজাতকে বিস্তারিত জানালাম, সে হেঁসে গড়াগড়ি, লটপট অবস্থা, শালা তুই এতো বড় ইডিয়ট, আজ জানলাম।লেকচার বন্ধ কর, কিছু সাজেসান থাকলে বল - বিরক্তির সুরে বললাম।
কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর সুজাত বলল- দেখ অনিশ তোকে প্রেমরোগ ধরেছে, তবে স্টার্টিংটা হেব্বি মাইরি!!!আমারই হিংসে হচ্ছে।
তুই কি কিছু বলবি না শুধু ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করবি।
দ্যাখ অনিশ বিষয়টি বেশ রহস্যে ভরা, তুই কেন তোর জায়গায় আমি থাকলে কিন্তু আমারও একই অবস্থা হতো। চিন্তা করিস না, তুই লুজ হয়ে যাস না, তোকে খেলাবে, আর তুই তার ইশারায় খেলবি!!এটা হতে পারে না গুরু। কোচের দিশা-নির্দেশ ঠিক আছে কিন্তু গ্রাউন্ডে তো প্লেয়ারকেই নিজের বুদ্ধি খরচ করে খেলতে হয়।
কিছু বুঝলি?
আমি নিরুত্তর।
শোন, তুই একটু চুপচাপ হয়ে যা। গুরুত্ব দিস না, না জানার ভান কর,দেখবি ইঁদুর আপনা আপনি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য। নিজে ভুল করে গর্তে আঙুল ঢুকাতে যাস না যেন নইলে কামড় খেতে হবে... বলেই সুজাত হো হো করে হেঁসে উঠলো।
একেই বলে অভিজ্ঞতা। সুজাত নাসরিনের সাথে গত তিন বছর ধরে চুটিয়ে প্রেম করছে, একই কলেজের, এক বছরের জুনিয়র। নাসরিন একদিকে প্রেমিকা আর অন্য দিকে সুজাতের হাফ বউ। দুই পরিবারের সম্মতিতে সুজাত ও নাসরিনের রেজিষ্ট্রি বিয়ে হয়ে গেছে, এমবিবিএস পাশের অপেক্ষা মাত্র, তারপর বাকি অনুষ্ঠানে। এরেঞ্জ রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ। আমি ছাড়া আর কোনও কাকপক্ষিতে জানে না। তাই হাফ বউ বলে সুজাতকে মাঝেমধ্যে খ্যাপায়।
নাসরিনের সাথে একবার কথা বললে কেমন হয়? তাহলে শ্রীশ্রী সুজাত আহমেদের কথা কতটা যুক্তিযুক্ত বোঝা যেতো, সুজাতটা যা বাচাল!! কিন্তু বিষয়টি সাতকান হয়ে যাবে। নাসরিনকে ভরসা করা যায় না, ওর পেটে কিছুই থাকে না।
কিরে, একবার নাসরিনকে জিজ্ঞেস করবি নাকি? শালা এক লাথ মারবো, আমার উপর ভরসা নেই? ও কি বোঝে প্রেম ভালোবাসার কথা, কোনও দিন আমার সাথে প্রেম করতে দেখেছিস ওকে? ছায়া বউয়ের মতো ৩ বছর ধরে এটা করবে না ওটা করবে না....কান ঝালাপালা করে রেখেছে, ২৪ ঘন্টা শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর। ধুর শালা কলেজ লাইফটাই পুরোপুরি নষ্ট!
আমি কষ্টের মধ্যে হেঁসে ফেললাম। ছায়া বউ ডিকশনারিতে নতুন। দ্রুত ভাইরাল করতে হবে।
দ্যাখ অনিশ, বেশি মাথা ঘামাস না, যে টোটকা দিলাম, তাতেই কাজ হাসিল হবে, বিশ্বাস রাখ। দাঁড়া বাইকটি নিয়ে আসি, তোদের ঐদিকে যাওয়ার প্রোগ্রাম আছে, তোকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবো।
কপট সুরে বললাম, তোর মনের কথাগুলো নাসরিনকে জানাতে হবে। সুজাতের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম পাংশুটে হয়ে গেছে, প্লিজ দোস্ত এই গর্হিত কাজটি করিস না, খুব ভালো মেয়ে ও! আমি এমনি এমনি বলে ফেলেছি।সুজাতের বেগতিক অবস্থা দেখে মনে মনে খুব খুশি হলাম, যাক ওকে জব্দ করতে পেরেছি।
সামনে সোমবার থেকে ভিন্ন সময়সূচী মেনে চলতে হবে, আমি আর সুজাত একই গ্রূপে, ছাত্র থেকে জুনিয়র ডাক্তার, বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ, চাল চলনে ভিন্ন মাত্রা, মার্জিত কথাবার্তা হেব্বি ব্যাপার স্যাপার। নতুন লুকটা চোখের সামনে ভেসে আসছে, গত ৩ বছর যাবৎ অনাথ, দুই কুলে কেউ নেই, সম্বল বলতে দূর সম্পর্কের মাসি, কিন্তু বাবা গত হওয়ার পর কেউ খোঁজ খবর রাখে নি, যদি হাত পাতি! কি ভাবে মেডিকেল পড়া, থাকার খরচ বহন করছি, আমি আর সুজাত ছাড়া আর কেউ কোনও দিন উপলব্ধি করতে পারবে না। ভিন্ন ধর্মের হয়েও সুজাত উপকার করেছে, সে ঋণ পরিশোধ করার মত সাধ্য অন্ততঃ আমার নেই। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো বিগত কয়েক বছর আগলে রেখেছে, সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না সবেতেই সুজাত। আর মাহিনের পরিবারের কথা না উল্লেখ করলে মহাপাপের ভাগী হবো, উনাদের প্রিয় মাস্টারমশাই। বাবা মারা যাওয়ার পর, ফ্ল্যাটের ভাড়া নেয়া বন্ধ, উপরন্তু মাহিনের টিউশনি ফি জোরজবরদস্তি হাতে গুঁজে দেন। অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসছে, ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা, বাবার স্বপ্ন ও অনেককিছুই। নিজের জন্য কিছুই ভাবিনি, আদর্শ ডাক্তার হয়ে যদি সমাজের সেবায় আসি নিজেকে নিঙড়ে দিতে পারি তবেই নিজেকে ধন্য মনে করবো।
কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি? নাম তাড়াতাড়ি নাম।আশ্চর্য, আমি কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিলাম। বাইক থেকে নেমে সুজাতকে টাটা বাই বাই করে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলাম, প্রবেশ করতেই ছায়া-ওয়ালির কথা মনে পড়ল, কেমন দেখতে, সাদা না কালো, লম্বাটে না বেঁটে, তন্বী না স্থূলকায়, টানা টানা চোখ না সাদামাটা....। আদোও ছায়া ওয়ালি না ওয়ালা হলফ করে বলতে পারবো না। শুধু ছায়ায় দেখেছি, চাক্ষুষ দেখা দেয় নি। মনের ভ্রমও হতে পারে।
অজান্তেই ব্যালকনির দরজা খুলে উঁকি দিলাম, কোনও কাগজের দলা খুঁজে পেলাম না। মনটা ছটপট করতে লাগলো।ব্যালকনি বন্ধ করে ওয়াশ বেসিনের কাছে আসতেই কলিং বেলের শব্দ, তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই দেখি এক ভদ্রমহিলা।
নমস্কার প্রতি নমস্কারের পর্ব শেষে উনাকে ভেতরে বসতে বললাম।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমি আপনার পেছনের ফ্ল্যাটে থাকি। মাথায় বাজে পড়ার মতো অবস্থা, তাহলে কি ইনিই কাগজের দলা বর্ষণ করছিলেন।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, বলুন!
মাহিনের মায়ের মুখে শুনলাম আপনি ডাক্তারী পড়ছেন, আমার স্বামীর, মনে হচ্ছে কার্ডিয়াক এট্যাক হয়েছে।
ও!! চলুন দেখি কি করা যায়।
ভদ্রলোক অচৈতন্য, হাতের নাগালে কোনও ফার্স্ট এইড নেই, অগত্যা সময় নষ্ট না করে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাক সময় মত চিকিৎসার কারণে ভদ্রলোক এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন।
দু তিন দিনের মধ্যে খেয়াল করলাম পাড়ার সকলেই একটু অন্য নজরে দেখছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, যেন এভাবেই মানুষের সেবা করতে পারি।
আশ্চর্য ছায়া-ওয়ালির কোনও পাত্তা নেই। রাতের দিকে সুজাতকে ফোন লাগলাম, এদিক সেদিকের কথা বার্তা বলার পর আসল বক্তব্যে এলাম, সঙ্গে সঙ্গে সে হো হো করে হাসতে লাগলো, ইচ্ছে করছে ফোনের মধ্যে ঢুকে সামনের দাঁতগুলো ঝড়িয়ে দিই! দোস্ত ঘুমিয়ে পড় আর ছায়াওয়ালিকে ভুলে যা। কাল মর্নিং শিফট আছে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
গুডনাইট বলে ফোন কেটে দিলাম।
# পর্ব:: ৪
পরদিন ডিউটি থেকে ফিরে, বিশ্রাম করছি, সেই ভদ্র মহিলার ফোন, রিং শুনে আঁতকে উঠলাম, ভয়ে বুক দুরদুর করতে লাগলো, আবার কোনও অঘটন ঘটলো নাকি?
হ্যালো ডাক্তারবাবু! হ্যালো বলতেই, উনি সস্নেহে বললেন, একটি অনুরোধ আছে, আজ রাতে আমাদের এখানে খেতে হবে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললাম, অযথা কষ্ট করার কি দরকার। ভদ্র মহিলাও নাছোড়বান্দি, অগত্যা রাজি হলাম।অগত্যা নাও হতে পারে, হয়তো জেনে শুনেই রাজি হয়েছি, যদি ছায়াওয়ালির সাক্ষাত মেলে!!
ডিনার শেষ করে ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। ছায়াওয়ালির নামগন্ধ পেলাম না।
ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে গেলাম ও ছায়াওয়ালি স্মৃতির পাতা থেকে মলিন হতে লাগলো। অবশেষে জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন এসে গেল, হাতে এমবিবিএসের ডিগ্রি, স্বপ্ন পূরণ। আনন্দের সাথে অপেক্ষা করছিল বিচ্ছেদ। বিষাদ পর্ব, সমস্ত বন্ধু বান্ধব, সহপাঠী, শিক্ষক গণ, অন্যান্য স্টাফ, ক্লাসরুম..... আর আমার প্রিয়বন্ধু সুজাত, কারোই চোখের জল থামছিল না, নাসরিন পঁই পঁই করে বলল, দাদা সামনে বছর আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান, মালদা আসতেই হবে, যেখানেই থাকুন না কেন!
ইতিমধ্যে আমার প্রাণপ্রিয় মাহিন আমারই কলেজে এমবিবিএসে চান্স পেয়েছে, আমার খুশির অন্ত নেই। কাকু কাকিমা ও মাহিনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখের জল মুছতে মুছতে কাকিমা বললেন তুমিও আমার ছেলের মতো, যেখানেই থাকো না কেন কোলকাতা এলে এই ফ্ল্যাটেই উঠবে, তোমার জন্যই খালি থাকবে।
কি হে মাস্টারমশাই! সঙ্গে সঙ্গে জীব কেটে বললেন সরি সরি ডাক্তার সাহেব, এতদিনের বদঅভ্যাস কি সহজে দূর হয়। কাকুকে প্রণাম করে বললাম না কাকু আপনার মাস্টারমশাই ডাকটাই আমার পছন্দ।মাস্টারমশায়ের পদবিতে আপত্তি নেই বরং ভালোই লাগে। কাকু বুকে জড়িয়ে নিলেন। খুব বড় হও, জীবনে উন্নতি করো। কাকুর চোখের কোণে জল!
সম্পর্ক কি হয়, এতদিন বুঝিনি, রক্তের সম্পর্কই যে শুধু আসল সম্পর্ক নয় কলকাতা এসে বুঝলাম। সম্পর্কের যদি আসল ব্যাখ্যা করা হয় তবে সে সম্পর্কের জলজ্যান্ত উদাহরণ সুজাত ও মাহিনের পরিবার। কলকাতা ছাড়ার আগে যে চোখের জল ফেলতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।
মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকূল থানার এক গ্রামের হেলথ সেন্টারে পোস্টিং। ফ্ল্যাটে যা কিছু টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল গোছাগুছি করার সময় দেখি একটা অপরিচিত ডাইরি, বুক ধড়পড় করে উঠলো। খুলে দেখি, প্রথম পাতায় পরিষ্কার বাংলাতে লেখা "অনিশদা, জীবন যুদ্ধে হেরে গেলাম! সামনে আসার সাহস পেলাম না, ভালো থাকুন ও জীবনে অনেক অনেক উন্নতি করুন। ইহলোক পরোলোকের ওপারে যদি কিছু থাকে সেখানেই অপেক্ষা করবো "।
পাগলের মতো পাতাগুলো পাল্টাতে লাগলাম।পায়ের তলার মাটি ক্রমাগত কাঁপছে আর একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। হাত পা সবকিছুই অবশ, চারপাশটা যেন বন বন করে ঘুরছে, সুজাতকে ফোন করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এক ছায়াওয়ালি ক্রমশঃ দূরে চলে যাচ্ছে, অনেক দূরে, একেবারেই না গালের বাইরে।
অদূরে মাহিন অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে, চোখের একূল ওকুলে ছাপিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাঁধভাঙা জল!!
**********
** লেখক এম ওয়াসিক আলি, একজন আইটি বিশেষজ্ঞ। ভারত সরকারের অধীন রাষ্ট্রীয় জলবিদ্যুৎ নিগমে কর্মরত।
অসাধারণ। শেষে পড়তে পড়তে কান্না পাচ্ছিল। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDelete