সত্যি যদি এমন হতো

এডমিন
0

65

অনুগল্প::  সত্যি যদি এমন হতো
কলমে: এম ওয়াসিক আলি


টিং-টং, টিং-টং......

হায় হায়..... তালি বাজিয়ে সে আসার সূচনা দিল।

দরজা খুলেই, গৃহকর্ত্রীর মেজাজ সপ্তমে। সুর চড়িয়ে বললেন-তোমাদের লজ্জা করে না, মৃত্যুতেও তালি বাজিয়ে বখশিশ নেওয়ার ধান্দা শুরু করেছো।

আগন্তুক কাঁচুমাচু হয়ে বলল- ক্ষমা করবেন মা, জানতাম না এ বাড়িতে কেউ মারা গেছে। দয়ালু, দানী হিসেবে আমাদের সমাজে আপনার খুব সুনাম। তাই ভাবলাম একবার যাই। 

ভুল হয়ে গেছে মা - বলে সে চলে যেতে লাগল।

দাঁড়াও....। গৃহকর্ত্রীর ডাকে সে থমকে দাঁড়াল।

একটু দাঁড়াও আসছি.....

না মা না, বখশিশ লাগবে না। আমতা আমতা করে বলল .... কে মারা গেছে মা? 

আমার স্বামী।

আগন্তুক মাথা ঝুঁকিয়ে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার পর বলল - 
ওহ! মনে হচ্ছে বাড়িতে আপনি একা!!
আর কেউ নেই? ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতি?

গৃহকর্ত্রী সুর নরম করে বললেন-থাকবে না কেন?কি কুলুক্ষণে কথা বলছো!!!
আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে!

ও!!! কাউকে তো দেখছি না মা?

না ওরা নেই বাড়িতে, ওরা দুজনেই বিদেশে থাকে। বলার পর গৃহকর্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিষয়টি কিন্তু আগন্তুকের নজর এড়ালো না।

বিদেশে? কোথায়?

গৃহকর্ত্রী জানালেন - মেয়ে বিয়ের পর লন্ডনে  আর ছেলে বউসুদ্ধ আমেরিকাতে থাকে।

হায়!, হায়!, কি ঘোর কলিযুগ! বাপের মৃত্যুতেও কেউ এলো না? এমন ছেলেমেয়ে থাকা আর না থাকা সমান।

গৃহকর্ত্রী কানে কথাগুলো তীরের মত বিঁধল।

চুপ করো। কেন আসবে না, মেয়ে এসেছিল, ছেলে ছুটি পায় নি, বলে আসতে পারে নি।আর জানো তো আমেরিকা থেকে বউ বাচ্চা কাচ্চা দের নিয়ে আসা যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা আর খরচ! 

ছেলে অবিশ্যি ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবার অন্তিম যাত্রায় উপস্থিত ছিল।

এই তো মেয়ে আমার কাছে দু-দিন থেকে গেল, স্বামী-ছেলেমেয়ে ছেড়ে আর কদিন থাকবে বলো। রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে খোঁজ খবর নেয়। ছেলেও সময় পেলে ফোন করে। 

আর কি চাই আমার? কথাগুলো এক নাগাড়ে বলেই গৃহকর্ত্রী আগন্তুকের দিকে তাকালো।

গৃহকর্ত্রী স্পষ্ট লক্ষ্য করল, কথাগুলো বলার পর গৃহকর্ত্রীর চোখ ছলছল করছে।

সে গৃহকর্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বলল- আমার নাম রত্না আর মোবাইল নাম্বারটা সেভ করে রাখেন, রাত বিরেতে যখনই দরকার পড়বে, একটা কল দেবেন। আপনাকে কোনও চিন্তা করতে হবে না, সঙ্গে সঙ্গে হাজির হব।

চোখ মুছতে মুছতে গৃহকর্তী বললেন-তুমি কেন সাহায্য করবে? 

এমনিই, মানবিকতার খাতিরে। আপনার বয়স হয়েছে, বাড়িতে কখন কি দরকার পড়ে। সত্যি বলতে কি আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। আপনার মনটি খুব নরম। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে মনে শান্তি পাবো, অন্ততঃ মায়ের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারবো। এই কিন্নরের জন্ম তো আপনার মত কোনও মায়ের গর্ভে। কিন্তু কেউ মেনে নেয় নি আমাকে, না মাতা পিতা, না সমাজ, না পরিবার, সম্পর্ক বলে যে কিছু হয়, জানি না মা। আমারই মতোই কিছু অভাগীর সাথেই হেসে খেলেই কাটে জীবনের প্রতিটি সকাল সন্ধ্যে।সমাজে পরিহাসের পাত্র আমরা,  সুখ-দুঃখ,কষ্টই জীবনের আভূষণ আর সম্পদও।

শখ করে কি কেউ তালি বাজায় মা? 
পাপী পেটের দায়ে করতে হয়, বদলে ভাগ্যে জুটে শুধু ঘেন্না আর ধিক্কার! 

আর হ্যাঁ, কিন্নরের সাহায্য নিলে ছোট হয়ে যাবেন না মা, তবে, কৌতুহলী পাড়া প্রতিবেশীরা ফিসফাস করতে পারে।

কথাগুলো শেষ করে --- রত্না দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

গৃহকর্ত্রী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল- কই নাম্বারটা দে, বলেই রত্নাকে জড়িয়ে ধরলো।

কিছুক্ষণ পরে রত্না চলে গেল। 

গৃহকর্ত্রী নির্বাক দর্শকের মতো স্মৃতির পাতা পাল্টাতে পাল্টাতে তিরিশ বছর পেছনে  এক জায়গায় থমকে গেলেন। সবকিছুই চোখের সামনে স্পষ্ট, বিবেকের দংশনে  ছিন্নভিন্ন মন, অজান্তেই বেদনাতুর স্বরে বললেন "ক্ষমা করে দিস মা! সেদিন  আগলে রাখতে পারিনি নইলে আজ একটা রত্না পাশে থাকতো"।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !