এভাবেই বইবে ধারা

এডমিন
0

এভাবেই বইবে ধারা


চল্লিশ উর্দ্ধ প্রবাসী বাঙালি।প্রায় কুড়ি বছর ধরে বিদেশে চাকুরীরত । এতদিন বিদেশে চাকরি বাকরি করে একঘেয়েমি ধরে গেয়েছিল,নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই সেখানে। বিদেশ ভুঁইয়ে আর থাকার ইচ্ছে করে না।ভূতে ধরার মত দেশে ফেরার টান ক্রমশই তাড়া করছিল। নাম-যশ, অর্থ প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই বাকি ছিল না যা বছর পয়তাল্লিশের জীবনে অর্জন করতে পারিনি।  একদিন হুট করে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসার মনস্থির করে ফেললাম। সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছি আর সাত পাঁচ না ভেবে দেশে ফিরে আসার তোড়জোড়ে মন দিলাম। বিগত কয়েক বছরে যা কিছু উপার্জন করেছি আশা করি তাতেই বাকি জীবনটা হেসে খেলে কেটে যাবে।  সম্পূর্ণ হাতপা ছাড়া নির্দায় সাধারণ ছাপোষা প্রাণী। না  আছে পরিবার,না বৌ-বাচ্চা, কেউ নেই একুল অকূলে। ফলে সংসারিক চিন্তা ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। নিজের জীবদ্দশায় মা কম চেষ্টা করেননি আমাকে সংসারী দেখতে। বেচারির ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেল। বেচারি দুনিয়া থেকে চলে গেলেন, বুকের মাঝে শেষ ইচ্ছেটুকু দাফন করে। 

দেশে ফিরে সম্পূর্ণ বেকার। চাকরি বাকরি করার ইচ্ছে নেই, আর করেই বা কি হবে, যেটুকু জমি জায়গা আছে সেই ফসল থেকেই নিজের প্রয়োজন ভালো ভালোই মিটবে। দেশে ফেরার পর কিছু দিনের মধ্যেই একটা যুতসই কাজ খুঁজে পেয়েছি, যাযাবর পাখিদের মতো আশি বছরের উর্দ্ধের বয়োজ্যেষ্ঠদের খোঁজে টোটো করে ঘুরে বেড়ানো। আজকের যুগে আশি বছর হেঁসে খেলে কাটানো খুব কঠিন কাজ। আশি পৌঁছতে পৌঁছতে বেচারা বুড়োদের অবস্থা শোচনীয় থেকে যদি আর কিছু শোচনীয় অবস্থা থাকে সেই অবস্থা হয়। পরিবারের উদাসীনতা, আদর যত্নের অভাব তৎসহ জটিল রোগ বালায়, এসবের সাথে এঁটে উঠতে পারেন না। নিঃসঙ্গতা ও অবহেলায় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া শ্রেয় মনে হয়। এদিকে বিদেশ থেকে ফেরা প্রায় মাস ছয়েক অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু আশি  ঊর্ধ বয়স্কদের দেখা মেলে না, বড়ই দুষ্কর কাজ। এখন পর্যন্ত বড় জোর বছর সত্তরের মধ্যের বয়োজ্যেষ্ঠদের খোঁজ পাওয়া গেছে।সাধারণত পঁয়ষট্টির আগেই বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

হালের কচিকাঁচাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার একটু আধটু চেষ্টাও করেছি, কিন্তু তাতেও বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি।জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা কথা আছে, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের যুগের খেলাধুলা এখন পুরোপুরি মধ্যযুগীয় বা আউট ডেটেড, গ্রামে গঞ্জে কেউ আর ডাংগুলি, গাদ্দি, হাডুডু কিংবা গাছে উঠে চোর ধরা খেলা খেলতে চায় না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো অভিভাবকদেরই উৎসাহ নেই, ছেলেরা কি ছাই  খেলবে।

স্মার্টফোনের যুগের কচিকাচারা কোনও কিছুই চিনতে বা জানতে চাই না এবং চেনার নূন্যতম চেষ্টা টুকুও করে না। মোবাইল, টিভির ভার্চুয়াল জগতে বুঁদ হয়ে আছে। পরিবারে বাবা, মা বড়োজোড় আর একটা ভাই বা বোন, এদের জগৎ এতটুকুই পরিধির মধ্যে সীমিত। চাচা চাচী, মামা মামী, দাদু দিদা এই সমস্ত শব্দগুলি মোটেও সুপরিচিত নয়। সুতরাং মন খারাপ করে লাভ নেই বরং বয়োজ্যেষ্ঠদের খোঁজ খবর পেলে, উনাদের সাথে কিছু সময় কাটানো যাবে, উনাদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো উনাদের মন হালকা হবে যারা সম্পূর্ণ একাকী, বাধ্য নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে।

হঠাৎ একদিন বাজারে, এক সব্জি বিক্রেতার মুখে এক বিরানব্বই বছরের বৃদ্ধের খোঁজ পেলাম। বিশদ খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম একদা উনি আমার বাবার শিক্ষক ছিলেন। খুব রাগী স্বভাবের। সে যুগের ছাত্র ছাত্রীরা উনার ভয়ে সিটিয়ে থাকতো। শুধু নজরে পড়া বাকী, পরবর্তীতে শাস্তি কেন দেওয়া হল সে ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করা যেত না, ছাত্রের কপাল খুব খারাপ থাকলে ছাত্রের অভিভাবকের নামে সমন জারি হতো, সেই সমন অমান্য করার ক্ষমতা কারও ছিল না, এমনই জাঁদরেল শিক্ষক। পথে ঘাটে কোনও অভিভাবকের সাথে দেখা হলেই বিপদ,  এই যে রতিন আজকাল দেখি রাস্তায় লোকজন দেখতে পাও না? ছেলে কি পড়ছে না পড়ছে কোনও খোঁজ খবর রাখো? বেচারা অভিভাবক কাচুমাচু, কি বলবে তিনিও এককালে ভুক্তভোগী ছিলেন এবং  কত মার খেয়েছেন ইত্যাত্তা নেই। রতিন ছেলের প্যান্ট খুলে দেখো, ব্যাস!! বাড়িতে খবর পৌঁছে গেল। সন্ধ্যার আর এক প্রস্থ উত্তম-মধ্যম কপালে জুটবে হয়তো বিনা কারণেই। সে যুগের বাবা-কাকা আর কংস মামার মধ্যে খুব খুশি তফাৎ ছিল না।

বহু কষ্টে কাঠখড় পুড়িয়ে এক অ্যান্টিক বৃদ্ধের খবর পেয়েছি সুতরাং আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ  বেরিয়ে গেলাম।

বহু পুরোনো বিশাল বাড়ি, বৃদ্ধের জন্মের আগেরও হতে পারে, চুনকাম করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আজকাল ধুতি পাঞ্জাবি, ফতুয়ার চল নেই আর দেখাও মেলে না। ভদ্রলোকের আপাদমস্তক দেখে বুঝতে পারলাম বনেদি পরিবারের সন্তান। বেশ পরিপাটি সাজ, ধুতি পাঞ্জাবি সাথে বাহারি কারুকার্যে অলংকৃত ছড়ি। বনেদিআনার ঝলক সর্বত্রই, থাঁটবাট এখনও বিদ্যমান।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখি সামনে বিশাল আঙিনা, একপাশে নিম গাছের তলায় তেল চকচকে চৌকি পাতা আর পাশাপাশি দু খানা চেয়ার আর আরাম কেদারায় উনি দুলছেন।

কালো ফ্রেমের পুরু ধূসর চশমাখানি চোখের একটু উপরে তুলে বললেন, কে গা তুমি?

দাদু আমি হায়দার.....

কোন হায়দার?

আমতা আমতা করে বললাম, দাদু, আমার বাবা আপনার প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।

প্রাথমিক পরিচয়টুকু দেওয়ার পরও সন্দেহ যায় না।

কিসের দাদু হে ছোকরা? চিনি না জানি না আবার নাতিত্ব ফলাতে এসেছো?

শোন বাপু আমি কোনও হায়দার টায়দারকে চিনি না। 

কি চাই? চাঁদাটাডা চাইলে দিতে পারবো না।


বেশ কটমট করে আমার দিকে তাকালেন, মনে হল যেন চিবিয়ে খাবেন।

আপনি ভুল বুঝছেন, আমি চাঁদা চাইতে আসিনি। আপনার সাথে একটু গল্প করবো বলে এসেছি।

গল্পের কথা শুনে বৃদ্ধের মন গলল।

কি জন্য এসেছো এবার একটু খুলে বল? কি নাম বললে তোমার বাবার?

একসঙ্গে  পরপরই দুটি প্রশ্ন, প্রথমটি খুব কঠিন, দ্বিতীয় টির উত্তর দিতে সমস্যা নেই।

পুনরায় আব্বার নাম ধাম, কবে থেকে কবে নাগাদ ছাত্র ছিলেন সব পুঙ্খানপুঙ্খভাবে জানালাম।

লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সং সেজে দাঁড়িয়ে কেন? যেখানে খুশি বসে পড়।

বহুদিন চৌকিতে বসিনি, ছোটবেলায় চৌকির উপর অনেক লাফালাফি করেছি, চৌকিতেই বসতে ইচ্ছে হল।

কাঁপা কাঁপা গলায় সর্বক্ষণের পরিচারক ও সঙ্গী গদাধর বাবুকে হাঁক দিলেন।

গদা এ গদা......

গদাধরবাবু হাঁপতে হাঁপতে সম্মুখে হাজির হলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, আমার প্রাণ হরণ করেই ছাড়বে তুমি, কতবার বলেছি এমন হাঁক করবে না।

বুক ধুরুপুরু করে, দেখবে ভয়ে কবে পটল তুলে দিয়েছি।


থাক থাক, অনেক হয়েছে, তোমার বুক ধড়ফরানি!

তোমার ফোন কথায়? ফোন করতে পারোনা কিংবা হটসঅাপ মেসেজ!!

অবাক হলাম ফোনের কথায়, হটসঅাপের কথায়। বাপরে বাপ বুড়োগুলো কি আধুনিক রে মাইরি!!!!
সত্যি সত্যিই লজ্জা পেলাম। আজকালকার কচি কাচারা শুনলে নিশ্চিত হার্টফেল করবে কিংবা লজ্জায় স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করবে।

যা দু কাপ চা নিয়ে আয়! দেখছিস না এই ছোকরা আমার সাথে গল্প করতে এসেছে। রমাকে বলিস মিষ্টি একটু কম দিতে, মিষ্টির সেরা যেন না করে।

গদাধর বাবুর মাথায় কিছুই ঢুকলো না, হইতো আমাকে বদ্ধ উন্মাদ ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে চা আনতে গেলেন।

দাদু আমাকে ছোকরা বলবেন না প্লিজ।

কেন হে লজ্জা পাচ্ছো।

হ্যাঁ দাদু, বিদেশ ফেরত সাহেব, লজ্জা তো পাবোই। ঠিক আছে আর বলবো না। এবার খুশি তো?

সত্যি সত্যিই আমি খুশি হলাম।

চা পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাদুর মুখ থেকে একটাও কথা বেরোলো না। আমিও ভয়ে চুপ।

চা পর্ব শেষে বৃদ্ধ বাবার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আব্বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, বছর পাঁচেক আগে আটষট্টি বছর বয়সে গত হয়েছেন।

বৃদ্ধ বহুক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন, প্রায় মিনিট পাঁচেক কোনও সাড়া শব্দ নেই,  নড়াচড়াও বন্ধ।

চিন্তায় পড়ে গেলাম।

হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, ও তুই জামালউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে?

সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম। মনে মনে খুব রাগ হল, এতক্ষণ ধরে তবে কার নাম ধাম শুনাচ্ছিলাম।যাক চিনতে পেরেছেন, খুব খুশি হলাম।

গাধাটা এতো তাড়াতাড়ি কি করে চলে গেল?

পিতাকে গাধা সম্বোধন করা কোন ছেলের কি ভালো লাগে? আমারও খুব খারাপ লাগলো।

ওকে কতো বুঝাতাম শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে না, শরীর চর্চাটাও গুরুত্বপূর্ণ.....আব্বার সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য পেলাম। মনটা অচিরেই ভালো হয়ে গেল।

সবই তো বুঝলাম বাপু, কিন্তু তুমি এখানে কেন? কি চাই একটু খুলে বলবে কি?

কিছুই না দাদু, এমনি এমনি দেখা করতে এসেছি। উনার বিশ্বাস হল না, উনার কপালের ভাঁজ দেখেই বুঝতে পারছি।

দাদু আপনি কেমন আছেন?

বৃদ্ধকে মনে হল ১১০০০ ভোল্টের কারেন্ট লাগলো।

এই কথাটা জানতে এসেছো?

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

উনি হো হো করে হেসে উঠলেন, এত হাসি! ভয় হচ্ছে  আরামকেদারা থেকে উল্টে পড়ে না যান।

গদাধর বাবু পুনঃ ছুটে এলেন, কি হয়েছে বারুজ্জে, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি, এমন করে হাসো কেন?

আরে গদা শোন, এই ছোকরা দশ ক্রোশ দূর থেকে এই জানতে এসেছে আমি কেমন আছি!!!!

দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, অগত্যা আমিও যোগ দিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে ধাতস্ত হওয়ার পর, খুব শান্ত সুরে বললেন, জনাব হায়দার চৌধুরী আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে? কেমন আছি, ভালো না খারাপ একা একা একাকী?

ক্লাসের বাধ্য ছাত্রের মত উত্তর দিলাম - মনে হচ্ছে খুব ভালোই আছেন ।

লক্ষ্য করলাম বৃদ্ধ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ পর চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছলেন ।

হায়দার চৌধুরী জানো তো জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। সবকিছুই দাঁড়িপাল্লা তুলে তোলমল করা হয়, সম্পর্কও । যাদের কে নিজের হাতে আদর যত্ন করে লালন পালন করলাম, উচ্চ শিক্ষিত করলাম তাদের কেউ আজ খোঁজ খবর রাখে না, বেঁচে আছি না মরে গেছে!!  আর রাখবেই বা কেন? ওদের সামনে সমস্ত ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, সকলেই নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। তাদেরও নিজস্ব সমস্যা আছে আর হ্যাঁ আমি ছেলেদেরকে আঁচলে বেঁধে রাখার জন্য শিক্ষা দিই নি, ওদেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে বলেও কিছু থাকতেই পারে।

কেউ নেই আমার আশেপাশে এই অন্তিম সময়ে, না ছেলে না বৌমা, না নাতি-নাতনি, কেউ নেই পাশে। আমিও কারু থেকে কিছুই আশা করি না। কিন্তু  খুব ভালো আছি। জীবনকে নিজের মতো করে উপভোগ করছি। সত্যি বলছি, মা কালীর দিব্যি!!!

আমতা আমতা করে বললাম- সেই তো দেখছি দাদু!!

কিন্তু আমার তো সেরকম মনে হচ্ছে না! তুমি কিন্তু অন্য কিছু ভাবছো আর মুখে অন্য কথা। কি জানি বাপু!! তোমাদের মনে এতো প্যাঁচ কেন বুঝি না।

কি ভেবেছিলে খুব খিট খিটে বদমেজাজি বুড়ো ভাম হবে, আর পাঁচটা বুড়োর মত ঘ্যানর ঘ্যানর করবে, নিজের দুঃখড়া গাইবে, না হায়দার চৌধুরী না তোমার অনুমান একেবারেই ভুল। আমি সময়ের প্রবাহের সাথে সাথে চলি, সমস্ত পরিস্থিতির সাথে অনায়াসেই মানিয়ে নিয়ে চলতে পারি। এই জন্যই খুব ভালো আছি, খুশি আছি।

ডারউইনের সেই তত্বটা মনে আছে? "সময়ের হাত ধরে না চললে বিলুপ্ত হতে দেরি নেই"!

গদা আর এক প্রস্থ চা খাওয়া না ভাই!!  মনে হচ্ছে হায়দার চৌধুরীর মাথা ঘুরছে।

খোঁচাটা মন্দ লাগলো না।

গদাধর বাবু মনে হয় তৈরি ছিলেন।  ১ মিনিটের মধ্যেই চা হাজির, আমিও একটু অবাক হলাম। গদাধর বাবু বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বাবু, বারুজ্জের অভ্যাস আমি জানি, কোন সময় কি চায়। আর আজ বহুদিন পর মনের ঝাল ঝাড়ার জন্য তোমাকে পেয়েছে।

মনে মনে হাসলাম।

ভাবলাম রতনে রতন চেনে। বারুজ্যে দাদু ও গদাধর বাবু একেবারেই একে অপরের পরিপূরক, যোগ্য সাথী। বৃদ্ধ বয়সে এসে প্রভূ ভৃত্যের এমন বন্ধুত্ব ও যুগলবন্দী সচারচর চোখে পড়ে না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে দাদু বললেন, ফেসবুক টেসবুক করা হয় নাকি?

সম্মতি জানাতেই একাউন্ট ডিটেলস চাইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর ঘন্টি বাজলো। অবাক হলাম, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট করলাম। কয়েক সেকেন্ড পর দেখি আবার ঘন্টি, মেসেঞ্জার এ দাদু কিছু লিঙ্ক পাঠিয়েছেন।

আরও অবাক হওয়ার বাকী ছিল!! দাদুর ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্ক। এবার কিন্তু আশ্চর্য না হয়ে থাকতে পারলাম না। এই বিরানব্বই বছর বয়েসে ইউটিউব ভিডিও যে ভাবে আপলোড করা হয়েছে, মনে হচ্ছে খুব নিপুণ হাতে এডিটিং করা। সুতরাং এডিট কর্তার বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ভিউ ও লাইক-কমেন্টস।

কিহে বাপু, মাথা ঘুরে গেল নাকি?

এসব আমিই নিজেই করি কারুর সাহায্য ছাড়াই।

আমার আর কিছুই বলার নেই, মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলাম।

দাদু মিটি মিটি হাসছেন। শোন হায়দার সময় পেলে আমার ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল দেখো। অভিনেতা বলতে আমি আর গদা আর কিছু কচিকাঁচা। আর বিষয়বস্তু নিশ্চিত বুঝে গেছো !

দাদু, আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেছি, কথা দিচ্ছি নিয়মিত পড়বো ও দেখবো।

আরও বিশদ জানতে পারলাম ওই চ্যানেল থেকে যে নিয়মিত আয় হয় সে থেকে পাড়ার কচি কাঁচাদের পড়াশুনার খরচাপাতি উঠে যায়।

দাদু আপনি খুব মজায় আছেন!!  আপনার প্রাণবন্ত জীবনযাপন ও আপনার প্রচেষ্টাকে স্যালুট।

কথাগুলো শোনার পর দাদুর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।

বেশ কিছুক্ষণ কটমট করে দেখার পর হাসি মুখে বললেন- একেবারে সত্যি কথা বলেছো। বৃদ্ধদের সাথে কথা বলে কি পাবে, ঘ্যানর ঘ্যানর ছাড়া, শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা ছাড়া,  এই সমস্যা, ওই সমস্যা,হ্যান ত্যান,  রোগ বালায়, দুঃখ কষ্ট ইত্যাদি ইত্যাদি নানা রকমের সমস্যার কথা তুলে ধরবে, কিংবা পাশবুক টাশ বুকের কথা তুলবে। আমি কিন্তু তাদের দলে নেই, নিয়মিত শরীচর্চা, ভালো খাওয়া দাওয়া, নিত্য নতুন লোকের সাথে কথা বলা, নতুন কিছু শেখা ও শেখানো ওসব নিয়েই ব্যস্ত থাকি, ফলে শারীরিক সমস্যার কথা মাথায় আসে না। দিন প্রতিদিন নিজেকে তরতাজা যুবক হিসেবে আবিষ্কার করি। আর হ্যাঁ সুযোগ পেলে আবারও প্রেমে পড়তে চাই, সে অষ্টাদশী কন্যা হোক বা অসতিপর বৃদ্ধার- কথাগুলো শেষ করেই দাদু পুনরায় হো হো করে হেঁসে উঠলেন।

আমার মনে হল, অনুভব যখন অল্প আঁচে ধীরে ধীরে কড়াইয়ে হালকা ঘি দিয়ে ভাজা হয়, তার রঙ, স্বাদ ও সুগন্ধ এর কোনও তুলনা হয় না। একটি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার, জীবন নদীর প্রবাহ সর্বদা আপন গতিতে চলা উচিত। চলার পথে সাময়িক বিরতিটুকুও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকলেই জীবন ও মৃত্যুর খেলায় রোমাঞ্চের রস  উপভোগ করা যায়।  জ্ঞানীগুণীরা বলে গেছেন - খুশি থাকাই জীবনের প্রথম ও শেষ সত্য।


কি ভাবছো হায়দার মিঞা-- দাদুর কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

কিছুই না দাদু।। এবার আমাকে উঠতে হবে, অনুমতি দিন।

সময় পেলে আবার এসো দাদু...….। এমন সুমধুর ডাক জীবনে কোনোদিনই শুনিনি, ভেতর থেকে কান্নার দলা মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। ছেঁড়া তারে সম্পর্কের নতুন সুর ভরে দেওয়ার মতই। এরই নাম কি বন্ধন। আজ "সত্য" মিথ্যে প্রমাণিত হল, এতদিন শুনে আসছিলাম রক্তের বন্ধনের কথা....... এতো উল্টো পুরাণ!!

আসি দাদু....আরও ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। বলেই বেরিয়ে এলাম।

আবার এসো দাদু.... দাদু...দাদু.... শব্দটা কানে ক্রমাগত বাজতে লাগলো।পেছনে ফিরে দেখি দাদু মুখে হাসির ঝিলিক, সেই অমলিন হাসি। দরবেশের মতো ক্রমাগত হাত নাড়িয়ে যাচ্ছেন।

পা দুটো অসাড় হয়ে গেছে, চলার নুন্যতম শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি, মন সামনের দিকে এগোতে অপারগ, কিন্তু মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !