ধুসর সন্ধ্যার অতিথি

এডমিন
0
ধুসর সন্ধ্যার অতিথি



পর্ব -১
হ্যালো!!! বল কি ব্যাপার সকাল সকাল ফোন দিয়েছিস?
ফোনের ওপারে কুহেলি... কাঞ্চনের বাল্যবন্ধু ও স্কুল থেকে কলেজের সাথী। বর্তমানে দুজনেই একই অফিসে চাকরি করে।
সকাল!!কি বাজে বকছিস!! ঘড়িটা দেখ সাড়ে নটা বাজে, আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস?
আরে...আজ সান্ডে , তুই তো জানিস আমি দেরি করে উঠি। বল কোনও বিশেষ কাজ?
নারে সে রকম কিছু না...আজ দুপুরে বর্ধমান যাবো, ভাবলাম তোর সাথে একটু কথা বলে নিই। ওখানে নেটওয়ার্কের কি অবস্থা জানি না, যদি কথা না হয়।
বর্ধমান, সেখানে গিয়ে তুই কি করবি, কই কালকে তো কিছু বললি না?
প্রোগ্রাম টা রাতে ঠিক হয়েছে , আর বাবাকে তো তুই ভালো করে চিনিস, সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি! আজ আমার মাসতুতো  বোনের ছেলের অন্নপ্রাশন, যেতেই হবে।
ও!! ঠিক আছে সাবধানে যাস, কবে নাগাদ ফিরবি?
কাল সন্ধ্যায়।
ঠিক আছে...বাই এনজয় কর বলেই কাঞ্চন ফোন কেটে দিল।ফোনটাকে বিছানায় ছুড়ে বাথ রুমে গেল, ফ্রেশ হতে রুমের বাইরে এসে দেখে বাবা যথা রীতি সোফায় বসে নিউজপেপার মুখস্ত করছেন।
কাঞ্চন আড় চোখে বাবাকে দেখে না দেখার ভান করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই বাবার ডাকে থমকে দাঁড়াল।
কোনও ভণিতা না করে কাঞ্চন বাবাকে বলল..কিছু বলবে?
বলতে তো অনেক কিছুই চাই, শুনবে তবেই তো!!!
কাঞ্চন বাবার পাশে গিয়ে বসল... কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল কই কিছু বলছো না, তা হলে যাই চা  খেয়ে আসি।
পিসি ....চা!!
দাঁড়াও!
কাঞ্চন থমকে দাঁড়াল, বাবার মুড সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।
তুমি কি আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দেবে না?
কেন আমি কি করেছি?
কিছুই তো করোনি, তাই তো এই অবস্থা, কিছু করলে কি আর কিছু বাকী থাকবে?
দেখো বাবা, বেশি ঘ্যানর ঘ্যানর করো না, তোমার সমস্যাটা কি, খুলে বলবে? মাথার দোষ থাকলে ডাক্তার দেখাও, আমি ব্যবস্থা করে দেব।আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
তুমি তো বেশ শান্তিতে ই আছো, আর আমার বুকের উপর চেপে তাণ্ডব চালাচ্ছ, শান্তি তোমার না আমার চাই!!
আচ্ছা, সকাল সকাল কি নাটক শুরু করলে বলো তো? শোনো বাবা তোমার এই বাঁকা বাঁকা কথা বন্ধ করো। যা বলার খুলে বল।
পিসি ও পিসি.....এক কাপ চা খাওয়াবে না...... তুমিও?
এই নে খা খুব চা খাও!!! পারলে আমাকেও খেয়ে নে।
যা বাবা....সবাই দেখছি প্রেসার কুকারের মত সিটি মারছে...তোমার আবার কি সমস্যা হলো পিসি?
কিছু না বলেই পিসি হন হন করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।
সাময়িক বিরতির পরে বাবা শুরু করলেন!!
শোন কাঞ্চন, আমি আর ফালতু হ্যাপা বইতে পারবো না, মনে রেখো আমার মান, সন্মান আছে। আমাকে সমাজ পাড়া প্রতিবেশী দের নিয়ে থাকতে হয়। সে সব তুমি কি বুঝবে!! সম্পর্কের মূল্যায়ন তোমার কাছে আশা করা বৃথা। আর যে কয়েকটি দিন আছি, শান্তিতে বাঁচতে দাও। বহুদিন ধরে বোঝাচ্ছি, কিছুই কানে ঢুকছে না, যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছ।বেহায়া পনা বন্ধ করো নইতো এ বাড়িতে তোমার কোনও স্থান নেই, ভেবে নেব তোমার মায়ের মত তুমিও মৃত। আর হ্যাঁ, আমার সম্পত্তির লোভ করো না। এই বাড়ি, ঘর দুয়ার, সম্পত্তি সবকিছুই কোনও এক অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দেবো, তুমি এক ফুটি কড়ি ও পাবে না।
ও বুঝেছি, আর কাসেট বাজাতে হবে না, বারবার শুনে শুনে ডায়লোগগুলি মুখস্ত হয়ে গেছে।
আচ্ছা বাবা! কাউকে ভালোবাসা কি পাপ? আর ভালোবাসা মানেই কি শারীরিক আকর্ষণ। ভালোবাসার অন্য কোন মানে হতে পারে না?
পাপ আমি তো বলিনি, কিন্তু প্রকৃতি যাকে ভালোবাসতে বলেছে, তাকে ভালো বাসো আমার আপত্তি নেই।
কেন আমি কি অপ্রাকৃতিক ভালোবাসার নিদর্শন দিয়েছি? তোমাকে আর কত বোঝাবো যেটা চোখে দেখছো সেটা আসলে সত্যি নই। আমাদের ভালোবাসা সেই ভালোবাসা নই সে তোমরা ভাবছো, পই পই করে এত বোঝাচ্ছি কেন তোমাদের মাথায় ঢুকছে না।
সব ঢুকছে...….মা, আমারও চোখ কান আছে। মাথার চুল এমনি এমনি পাক ধরেনি।
কি ভাবে পাক ধরেছে সে বিষয়ে জানতে আমার বিন্দুমাত্রও উৎসাহ নেই, এই কথাগুলো অন্য কোথাও শোনাও লোকে শুনবে।
আর শোনো বাবা স্পষ্ট করে আবার ও বলছি  - কাকে ভালোবাসবো, কাকে বাসবো না, সেটা আমার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত ব্যাপার, তোমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলতে বা শুনতে চাই না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও, প্লিজ বাবা......!
কি বললে, তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার?
হ্যাঁ। আর কতবার বলবো, স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দেবো নাকি, টিপ সহি সহ!
মনে রেখো, আমি তোমার বাবা। আমারও কিছু দায়িত্ব আছে এবং অধিকার ও আছে। তুমি যদি অস্বীকার করো, তাহলে আমারও আমাদের মধ্যের সম্পর্ক কে অস্বীকার করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
আর কিছু বলতে হবে না, সবকিছু রই ফয়সালা করে দিলে, ভালোই হল,  কাঞ্চন ঘরে ঢুকে গেল।
মিনিট দশেক পর কাঞ্চন একটি ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
আসি পিসি!! বাবাকে দেখো,  নিজেরও যত্ন নিও, এই বাড়িতে আমার আর জায়গা নেই।
পিসি রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসার আগেই কাঞ্চন ততক্ষণে বাড়ীর বাহিরে।
যতীন বাবু মেয়ের একম সিদ্ধান্তে কিংক্তব্যবিমূঢ়। এমন কথাবার্তা তো সে প্রথম বার বলে নি। কি এমন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল যে কাঞ্চন গৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। সবকিছু বোঝার আগেই কাঞ্চন এর এমন সিদ্ধান্ত।
কাঞ্চন চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত দরজার পাল্লা দুটি হালকা হালকা দুলছিলো। যতীনবাবু পলকহীন নয়নে যতদূর চোখ যায়, ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলেন কিন্তু মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন, কি বলবে, কি করবে মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
পর্ব -২
বনেদি পরিবারে জন্ম যতীনবাবুর, সারা জীবন অঢেল সম্পদ অর্জন করেছেন, দুহাত দিয়ে দেদার উড়িয়েছেন ও। যৌবন কালে এমন কোন শখ বাকী ছিল না, যা পুর্ণ হয়নি। মদের আসর থেকে নিষিদ্ধ পল্লী কিছুই বাদ যায় নি। সেসব কর্মের জন্য বিন্দু মাত্র অনুশোচনা নেই। বাড়ীর কর্তা, ছেলেকে সুপথে নিয়ে আসতে, বাবা মা চেষ্টা র কোনও ত্রুটি রাখেন নি। শেষে মা নাখে খত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন আমৃত্যু অন্ন গ্রহণ করবেন না যতদিন না যতীনের মধ্যে পরিবর্তন আসে। সব চেষ্টা বিফলে গেল, শেষমেশ আত্বীয়স্বজন ও পরিজনদের কথামত যতীনের বিয়ে দিলেন। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় কাঞ্চনের জন্ম। বাবা শত চেষ্টা করেও যে কাজটি করতে পারেন নি, জন্মের সাথে সাথেই কাঞ্চন সেই অসাধ্য সাধন করে ফেললো। কিন্তু দুঃখের বিষয় কর্তা কিছুই দেখে যেতে পারলেন না। যতীনবাবুর বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
একমাত্র মেয়ে কাঞ্চন, সদ্য এম.বি এ পাশ করেছে। যতীন বাবুর নয়নের মণি, তার কোনও সাধ আহ্লাদ বাকী রাখেন নি, কথায় বলে কালের কাঁটা আপন গতিতে চলে, শীতের শেষে বসন্ত, আবার বসন্তের শেষে গৃষ্য।  একমাত্র মেয়ে কিনা এক অন্য এক মেয়ের প্রেমে হাবডুবু!!! বিষয়টি আর চাপা নেই, সমাজে ছি ছি র! রোল। যদিও যতীন বাবু বা পিসি কেউই তাদের দুজনকে কোন দিনই আপত্তি কর অবস্থায় দেখে নি, হইতো মেয়েই ঠিক বলছে, ধরে ধরে কজনকে বোঝাবে? যতীন বাবুর সমাজে মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে গেছে ।আর হবেই না কেন? সমাজ কখনোই অস্বাভাবিক সম্পর্ক মেনে নিতে পারে নি। বাবার মতো মেয়েও সমাজ জেদী।
কাঞ্চন ও কুহেলি, সেই বাল্যকাল থেকেই একত্রে বড় হয়েছে। এম বি এ পাশ করার পর পরই সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদেশে চাকরি রত সফট্ওয়ার ইঞ্জিনিয়া রের সাথে ধুম ধাম করে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, দুয়েকের মধ্যেই ছাড়া ছাড়ি। তারপর থেকেই বাবার বাড়িতে। কাঞ্চনের চেষ্টাই একই অফিসে চাকরি। সমস্যার সূত্রপাত ঠিক তার পরেই। প্রথমে ফিসফাস,  ধীরে ধীরে অফিস এর গণ্ডি ছাড়িয়ে বাড়ী, বাড়ি থেকে পাড়া প্রতিবেশী ও রাষ্ট্র।
কি করে একটি মেয়ের সম্পর্ক অন্য একটি মেয়ের সাথে হতে পারে। যদিও আমাদের দেশে প্রায় ই শোনা যাচ্ছে।
যতিনবাবু কুহেলির বাবার সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, কিন্তু সমস্যা কার কুহেলীর না কাঞ্চনের কেউই বুঝে উঠতে পারেন নি।
ঘণ্টা খানেক পর যতীনবাবু কুহেলির বাবাকে ফোন লাগলেন, বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত রিং বাজার পর, ফোন তুললেন।সকালের সমস্ত ঘটনাবলী বিস্তারিত জানানোর পর জিজ্ঞেস করলেন কাঞ্চন ও বাড়িতে এসেছে কিনা!!
কিন্তু কাঞ্চন সেখানে যাইনি, তবে গেল কোথায়? কুহেলি মায়ের সাথে বর্ধমানের পথে!! এদিক ওদিক ফোন করা র পরও কাঞ্চনের কোনও খোঁজ পাওয়া গেলো না। কাঞ্চনের ফোনে ও সাড়া শব্দ নেই, হইতো ব্লক করে দিয়েছে।
দাদা কোনও খবর পেলে ?
না! হতাশ হয়ে যতীন বাবু সোফায় শুয়ে পড়লেন।
রমা.... বুকটা কেমন যেন চিন চিন করছে।
রমা ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন। মুখটা খোল দাদা, বলে জিভের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন ও পাঞ্জাবীর বোতাম খুলে বুকে মালিশ করতে লাগল।
মিনিট পনেরো পর কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর উঠে বসতেই রমার ফোন বাজতে লাগলো। অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ধরবে কিনা ভাবছে।
ফোনটা ধর রমা, দেখ হইতো কাঞ্চন করেছে।
সত্যি সত্যিই কাঞ্চনের ফোন, পিসি আমি ভালো আছি, চিন্তা করো না, বাবা কেমন আছে?
যদি বাবাকে এতোই ভালবাসিস তবে চলে গেলি কেন মা?
কি করবো পিসি, তুমি তো সব শুনলে, আমার উপায় নেই।
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয় মা, মনে হচ্ছে তোর বাবার মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছে । ওষুধ দিয়েছি।
কাঞ্চনের বুক ধড়াস করে উঠলো।
পিসি তুমি বাবার কাছে বসে থাকো আমি ডাক্তার কাকুকে খবর দিচ্ছি।
দশ মিনিট পর ডাক্তার জামিল এলেন ততক্ষণে যতীন বাবু উঠে বসেছেন। হার্ট বিট, প্রেশার সবকিছুই নর্মাল। তবুও একটা ইসিজি করে নিতে বললেন। বাড়ীর পাশেই ডিয়াগণাস্টিক সেন্টার।
চা পর্ব শেষে, উঠতেই দরজাতে কলিং বেলের শব্দ। পিসি তড়িঘড়ি করে খুলতেই দেখেন সামনে কাঞ্চন। কোনরকমে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না।
ডাক্তার জামিল, কাঞ্চনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবার যদি এতোই চিন্তা তবে কেন বাবাকে কষ্ট দাও।
সরি কাকু......।
ডাক্তার জামিল বাবার বন্ধু ও পারিবারিক ডাক্তার, ঢাকুরিয়াতে নিজস্ব নার্সিং হোম। শত ব্যস্ততার মাঝেও বন্ধুত্ব অটুট, দিনে অন্তত একবার একে অপরের খোঁজ নেওয়া অত্যাবশ্যক। আর প্রতি রবিবার বিকেলে ডাক্তার জামিলের বাড়িতে শতরঞ্জ খেলা।
ডাক্তার জামিল বেরিয়ে গিয়ে, পেছনে ফিরে কাঞ্চনকে ইশারায় কাছে ডাকলেন।
শোন মা, তোমার বাবা, হাইপার টেনশন, হাই সুগারের রোগী তদুপরি এটা তার দ্বিতীয় মাইল্ড অ্যাটাক, এরপর মারাত্বক কিছু ঘটে যেতে পারে। বিষয়টা তোমাকে বুঝতে হবে। সব কথা শুনলাম। দেখো তোমাকেই ভাবতে হবে। তোমার সমস্যা টা ঠিক কোথাই বুঝতে পারছি না। তুমি বিয়ে করতে চাও না, সেটা বুঝি। জন্ম থেকেই অসম্পূর্ণ। ইউটেরাস ও ডিম্বাশয় নেই তো নেই, কিন্তু তুমি তো এক সম্পূর্ণা নারী। সে রকম পাত্র দেখে বিয়ে করতেই পার, আজকাল কত জায়গা আছে সেখান থেকে বাচ্চা দত্তক নিতে পারো, আর তুমি যদি চাও এ বিষয়ে আমিই তোমাকে সাহায্য করবো।
কাঞ্চন সবকিছু চুপচাপ শুনতে শুনতে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
আচ্ছা মা, সত্যি করে বলো তো তুমি কি সত্যি সত্যিই কুহেলি কে ভালো বাসো না ওর প্রতি সহানুভূতিশীল। জানি কূহেলির বিয়েটা ফ্লিক ছিল, সে তো ঘুরে দাঁড়াতে পারে, নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। পুরুষ জাতির উপর ঘেন্না স্বাভাবিক। কিন্তু তোমরা দুজনে একে অপরের পরিপূরক হতে পারো না। তোমার বাবার কোনও দোষ দেখছি না।
কাকু আমার বড্ড ভয় করে...আমি এক অসম্পূর্ণ নারী, আমার বিবাহিত জীবন সুখের হবে না। পিসিকে দেখছি, বিয়ের এক বছর কাটতে না কাটতেই ..... অথচ সব কিছুই জেনে শুনেই বিয়ে হয়েছিল, আমি চাই না সে ঘটনার পুনরবৃত্তি হোক। পিসিও চাই না আমি বিয়ে করি, কুহেলি ও আমি সেই বাল্যকাল থেকেই একসাথে বড়ো হয়েছি, আমাদের মধ্যে প্রেম থাকুক আর নাই বা থাকুক আমরা একসাথে থেকেই একে অপরের দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিতে চাই খুব ভালো বন্ধু হিসেবে। সে জীবনে মারাত্বক আঘাত পেয়েছে। আমাদের সম্পর্ক সমাজ মেনে নেবে না কেন, কোনও অন্যায় কাজ করছি না, আমাদের সম্পর্ক খুবই পবিত্র। এর মধ্যে কোনরকমে র টানাপোড়ন থাকবে না। আমরা কেউই সমকামী নয়, আমারও পুরুষের প্রতি কামুক ভাব অনুভব করি। একথাটা বাবাকে কোনোমতেই বোঝাতে পারছি না।
ডাক্তার কাকু হাসলেন.....।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- বুঝলাম, আমিই ভুল, তোমার বাবার কথা শুনে তোমার সম্পর্কে অন্য ধরনের ভাবনা কাজ করতে শুরু করেছিল।
তবে তোমার বাবা হলে ,আমিও বুঝতাম না মা।
আসি মা, আর উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিস না।
ডাক্তারকাকু চলে যাওয়ার পর কাঞ্চন ধীরে পায়ে বাড়িতে ঢুকলো, বাবা সোফাতে বসে আছেন। খুব অনুশোচনা ও পাপ বোধ হচ্ছিল। বাবার চোখে চোখ মেলতে পারছে না।
বাবা!!!
যতীন বাবু কাঞ্চনের দিকে তাকালেন।
ক্ষমা করে দাও বাবা। আমাকে ভুল বোঝো না। তুমি যা ভাবছো সে সব কিছুই নেই আমার ও কুহেলির সে সবের বিন্দু মাত্র ছিটেফোঁটা ও নেই। আমাদের সম্পর্ক পবিত্র। আমাদের মধ্যে সম্পর্কের মূল্যায়ন অন্তত তুমি ঠিকঠাক মতো তুমিই করতে পারো। বাবা আমিও বাঁচতে চাই, আমাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিও না।
পিসি তুমিই বোঝাও না বাবাকে। বলে পিসিকে ধরে হাউন হ্যাও করে কাঁদতে লাগলো।
চুপ কর মা চুপ কর।
পিসি কাঞ্চনের চুলে আঙ্গুল চালাতে বললেন, তুই ছাড়া আমাদের কি আর কেউ আছে। তোর খুশিই আমাদের খুশি।
কিন্তু পিসি, আমিও তো তোমার মত অক্ষম, কিন্তু তুমি ভাগ্যশালি তোমার মাথার উপর দাদা আছে আমার তো কেউ নেই যে আগলে রাখবে। আমি কি করবো পিসি তুমিই বলো।
জানি মা সব জানি, কি করবি সবই ভাগ্যের দোষ।
ভুলে যাস না  আমরাও মানুষ, সভ্য সমাজে বাস করি। দেখছিস তো  কি অবস্থা, চারিদিকে শুধু টিটকারি আর টিটকারি। তুই পারবি না সমাজের সাথে লড়তে।
আই কিছু মুখে দে!! সকাল থেকে কিছুই খাস নি।
খিদে নেই পিসি......
কাঞ্চন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
বহুক্ষণ ধরে কুহেলি কে ধরার ফোনে চেষ্টা করল, ফোন পরিসেবা সীমানার বাইরে.....। রেগে ফোনটাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলল।
কিছুক্ষণ পর কূহেলির ফোন এলো... কিরে কি সব উল্টাপাল্টা কাজ করেছিস, এদিকে বাবা রামায়ণ মহাভারত শুনিয়ে শুনিয়ে মাথা খারাপ করে দিলেন।
শত কষ্টের মধ্যে কাঞ্চন হাসলো।
তুই কিছুই ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল দেখা হবে, রাখছি বলে কুহেলি ফোন কেটে দিলো।
বাড়ীর পরিস্থিতি থমথমে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে বাবা ঘুমোচ্ছে। পিসি ঝুম ধরে বসে আছে।
পর্ব -৩
পরদিন কাঞ্চন অফিসে একটু দেরি করে ঢুকলো, না কুহেলি আসে নি। অথচ সকাল সকাল আসার কথা, এদিকে অফিস থেকে ছুটিও নেই নি। ফোনেও পাচ্ছে না। মনটা চটপট করতে লাগলো। কোনও অঘটন ঘটেনি তো?
কিছুক্ষণ পরে বস ডাকলেন।
এসো কাঞ্চন, কুহেলির ফোন এসেছিল, এক সপ্তাহের ছুটি চাইছিল, এখন তো ছুটি মঞ্জুর করা খুব মুশকিল। রেগে ফোন কেটে দিলো আর ফোন ধরছে না।
কুহেলির হটস অ্যাপ মেসেজটা পড়ো, বলে বস মোবাইলটা কাঞ্চনের দিকে এগিয়ে দিল। কাঞ্চন কম্পিত হতে মোবাইল টা নিয়ে মেসেজে চোখ বুলাতেই, চক্ষু চড়কগাছ, হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঞ্চন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে গেল। অফিসের কলিগরা ধরাধরি করে সোফায় শুয়ে দিল। জলের ছিটে দেওয়াতে জ্ঞান ফিরল না। অগত্যা সকলে ধরাধরি করে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তার  ইনজেকশন দিলেন।
কাঞ্চনের বাবাকে ফোনে জানানো হল।
আধঘন্টার মধ্যে ডাক্তার জামিল কে নিয়ে বাবা পৌঁছলেন। অফিসের বস মোবাইলের মেসেজটা কাঞ্চনের বাবাকে ও ডাক্তার জামিলকে দেখালেন। ডাক্তার জামিল চেম্বারের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে কাঞ্চনকে নিজের নার্সিং হোমে নিয়ে গেলেন।
সবকিছুই ক্ষণিকের মধ্যে ঘটে গেল, অফিসের পরিস্থিতি থমথমে, বিষয়টি অনেকেই জানে না। বসও স্পিকটি নট। অফিসে কুহেলির অনুপস্থিতি ও কাঞ্চনের এই অবস্থা, নিশ্চিত কোনও বড় ঘটনা ঘটেছে। সকলেই উৎসুখ। এমনিতেই কাঞ্চন ও কুহেলির অসম প্রেম কাহিনী অফিসের নিচে হারুদার ঝালমুড়ির চেয়েও মুখরোচক।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর কাঞ্চনের জ্ঞান ফিরল, চোখ মেলল কিন্তু ভাবলেশহিন।  
উদ্বিগ্ন পিসি কাঞ্চনের  বা হাত নিজের দু হাতে জড়িয়ে বলল - তোর কি হয়েছে?
কাঞ্চনের চোখের পাতা নরছে না।
পিসির কান্না থামছে না। বাবা একেবারেই চুপচাপ। মেয়ের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না, সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী ভাবতে শুরু করেছেন। সত্যিই তো কাল সকাল থেকে ঘটা সমস্ত ঘটনাবলীর জন্য হইতো তিনিই দায়ী।
যতীনদা, রমা তোমাদেরকে  বাইরে আসতে হবে, পেশেন্ট হাইপার হচ্ছে।
সকলেই রুমের বাইরে চলে এলেন। ডাক্তার জামিল ইশারায় পিসিকে বসতে বলে যতীন বাবুকে সঙ্গে আসতে বললেন, বাধ্য বালকের মতো
ডাক্তার জামিলের পিছু পিছু উনার চেম্বারে গেলেন।
জামিল কি হয়েছে কাঞ্চনের? যতীন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
দাদা ও অনেক বড় শক খেয়েছে, সময় লাগবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে।
কিসের শক?
কুহেলি বিয়ে করছে।
বিয়ে করছে!!!! কি যা তা বকছো?
যা তা নয় যতীনদা, কুহেলি অফিসের বসকে হটসআপ করে সব জানিয়েছে আর কাঞ্চনের ফোন ধরছে না।
যতীন বাবু মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন।
দলা পাকিয়ে কান্না বেরিয়ে আসছে।
যতীন দা তোমাকে শক্ত হতে হবে, তুমি ভেঙে পড়লে বাকিদের কি হবে ভেবে দেখেছো বলেই ডাক্তার জামিল দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। কি জানি কাঞ্চনের ভাগ্যে কি আছে! এখন ওর যা মানসিক অবস্থা, হইতো এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে বহু সময় লাগবে।  আজকেই এক সাইক্রাটিক এর সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো, আমার চিন্তাধারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভাবতে পারছি না। বলেই যতীন বাবু ডাক্তার জামিল কে ধরে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
শান্ত হও যতীন দা, শান্ত হও সব ঠিক হয়ে যাবে।
রমাকে নিয়ে বাড়ি যাও, এখানে থেকে লাভ নেই, কাঞ্চনকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি, একটু ঘুমোক। তোমরা বিকেলের দিকে এসো।
বাড়ি ফিরে, যতীন বাবু বোনকে সব খুলে বলবো। পিসির চোখের জল ঝরঝর করে ঝর্নার মত ঝরে পড়ছে। দাদা ঠাকুর আমাদের এতো পরীক্ষা কেন নিচ্ছে বলো তো!! আমার সাথে যা হোয়েছে হিয়েছে তাই বলে এই ছোট্ট মেয়েটার উপর কেন ঠাকুর এত নিষ্ঠুর।
এমন বলতে নেই রমা...সবই ভাগ্যের দোষ।
দুপুরের খাবার খেতে খেতে কুহেলি র কথা মনে পড়লো।
যতীন বাবু পিসিকে ডাক দিলেন।
বল দাদা।
কুহেলি র নাম্বার আছে তোর কাছে।
না দাদা।
কাঞ্চনের ফোনের লক খুলতে জানিস?
না দাদা।
ঠিক আছে, তুই যা একটু রেস্ট কর।
পিসি চলে যাওয়ার পর যতীন বাবু কূহেলীর বাবাকে ফোন লাগলেন।
হ্যালো !
দাদা আমি যতীন।
তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে গেল।
বহুবার চেষ্টার পর ও ফোন তুললেন না।
কষ্টের মধ্যেও যতীন বাবু হেসে উঠলেন। একই বলে বাবা, দুই প্রান্তে দুটি বাবা নিজের নিজের মেয়েকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সব কিছুই কাঁচের মত স্বচ্ছ। গতকালও ঘুণাক্ষরেও কিছুই বুঝতে দেননি। বর্ধমান যাওয়া, অন্নপ্রাশন সবকিছুই পূর্বকল্পিত। কিন্তু কুহেলি সেও কি এই ষড়যন্ত্রে জড়িত?
যতীন বাবু র বুঝতে কিছুই বাকী থাকলো না, সমস্যা শুধু কাঞ্চনের, কুহেলি শুধুমাত্র পরিস্থিতি
র শিকার। কূহেলি র শুধুমাত্র সমবেদনা ছিল, ভালোবাসা ছিল না। আর বোকা কাঞ্চন কুহেলি কে নিয়ে মেতে গেল। সব কিছুই এমন ভাবে চলছিল যেন তারা সমকামী, একে অপরের পরিপূরক।
সবই নিয়তির খেলা।
পর্ব -৪
দুদিন পর বিকেলের দিকে কাঞ্চন নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেল। অবস্থা স্থিতিশীল কিন্তু ডাক্তারের উপদেশ কোনরকমে র মানসিক চাপ দেওয়া চলবে না। ডাক্তার জামিলের পরিচিত এক সাইক্রাটিকের অধীন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না সব কিছু স্বাভাবিক হয়। যদিও সাইক্রাটিক ডক্টর সেন অভয় দিয়েছেন কাঞ্চনকে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলবেন। আপাতত বাড়িতেই বন্দি থাকতে হবে, অফিস বা বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ।
সন্ধ্যার সময় পিসি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে বেডের পাশে রাখলো।
ওখানে রাখলে কেন পিসি, খাইয়ে দাও।
পিসির চোখ ছলছল করছে।
পিসি প্লিজ আমার সামনে কেঁদো না। দেখো আমি ভালো আছি আর খুব শীগ্রই ঠিক হয়ে যাবো একদম চিন্তা করো না।
আমার একটা কথা রাখবে পিসি।
বল....
তোমরা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।
থাক মা ওসব কথা।
সত্যি পিসি আমি খুব ভুল করেছি। আচ্ছা পিসি কুহেলি অমনটা কেন করলো কেন? তোমার কি মনে হয়?
পিসি আমতা আমতা করে বলল- কি করে ব লবো! আমিও ভাবছি, কিন্তু কোনও কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।
না পিসি অন্তত এক বার কুহেলি কে জিজ্ঞেস করতে চাই। সেচ্ছা য় সিদ্ধান্ত নিয়েছে না পরিবারের চাপে। সেদিন সন্ধ্যাতে ও ঠিক থাক কথা বললো, সব কিছুই নর্মাল, এক রাতের মধ্যেই কি এমন অঘটন ঘটলো যে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিল আর আমাকে জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলো না। জানো পিসি আমার এর পেছনে ভীষণ বড় ষড়যন্ত্র আছে বলেই আমার বিশ্বাস।
পিসি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল।
পিসি ঘুমিয়ে পড় লে নাকি সাড়া শব্দ নেই?
শুনছি....আর ভাবছি।
কাঞ্চন হো হো করে হেঁসে উঠল, হাঁসি কিছুতেই থামতে চায় না, বাবা ছুটে এলেন। বাবাকে দেখে কাঞ্চন চুপ করে গেল। কিছুক্ষন থাকার পর বাবা ও পিসি দুজনেই ঘরের বাইরে চলে গেল।
কাঞ্চন সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল, আবার ফেটে পড়া অষ্টহাসি। পিসি ছুটে এলেন, কি হয়েচে কাঞ্চন অমন করে হাসছিস কেন?
মানুষ জন কত মূর্খ ভাবো পিসি, আমরা নাকি সমকামী, ছি! ছি! টিটকারি সবই বিফলে গেল। ভাবছি এবার কি নিয়ে গসিপ করবে বলো তো পিসি।
যতীন ঘোষালের বোন ও মেয়ের ভেতরের টুলস ফাঁককা!!! না ঘোষালের মেয়ে পাগল!!!
হাঁসির সুর ক্রমাগত চড়তে লাগল।
পিসির চোখে জল, বাবা পুনরায় ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসে কাঞ্চনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
চুপ কর মা চুপ কর,  সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা আমার  ও পিসির ভেতরের টুলস গুলোও বলেই কাঞ্চন চুপ করে গেল।
রমা যা কিছু রান্না বান্না কর আমি বসছি  ।
ঠিক আছে দাদা বলে পিসি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়া লেন।
নটার দিকে খাওয়া দাওয়া সেরে রাতের ওষুধ গুলো যতীন বাবু নিজের হতে করে খাওয়ালেন, ওষুধ খাওয়া র কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঞ্চন ঘুমিয়ে পড়ল।
যতীন বাবু  পরম শান্তিতে ঘুমানো মেঁয়ের কোমল মুখটি দেখালেন। অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে মেয়েটির উপর দিয়ে। আহারে আমার মা মরা মেয়ে!!
রমা রাতে ওর কাছে থাকিস। বলে যতীন বাবু নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
পিসির উপর দিয়েও সারাটি দিন অনেক ধকল গেছে। তিনিও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন।
পর্ব -৫
সকাল সকাল যতীন বাবুর ফোন বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে নাম্বার, কোনও পরিচিতের নিশ্চয় নোয়, ধরবো কি না ধরবো করতে করতে গ্রীন বোতামে ক্লিক করতেই ফোনের ওপারে মহিলার কণ্ঠস্বর।
হ্যালো যতীন বাবু বলেছেন?
হ্যাঁ বলছি, আপনি কে বলছেন?
আমি বর্ধমান থেকে কুহেলির মাসি বলছি।
কুহেলির কোনো অঘটন ঘটলো নাকি!! যতীন বাবুর বুকটা ছাক করে উঠল। বুকের ধরকন দ্বিগুণ। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত সুরে বলল বলুন।
কাঞ্চনের সাথে একটু কথা বলা যাবে কি? ও কুহেলির ফোন তুলছে না।
ও এখন ঘুমোচ্ছে, যা বলার আমাকে বলুন।
খুব ব্যাক্তিগত, ওর সাথেই কথা বলতে চাই।
না এখন সম্ভব নয়।
ও,  তা হলে আপনাকেই বলছি।
বলুন।
কুহেলি বিয়ে করেছে, আমাদের  পরিচিত এক পাত্রকে। বর্ধমানেরই ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার।
খুব ভালো খবর, খুব খুশি হলাম, আপনাদের সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো।
ধন্যবাদ দাদা।
এই খবরটা তো আগেই শুনেছি কুহেলির বাবার মুখ থেকে। আপনি নতুন করে আবার শোনাচ্ছেন কেন? বলেই যতীনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
না ... আসলে, এই বিয়েতে কুহেলি রাজী ছিল না।
তো বিয়ে করতে গেল কেন ?
আপনি তো সবই জানেন!! নতুন করে আর কি বলবো, পাত্রের পছন্দ হয়ে গেল, আর আমরাও আর আর ভাবলাম না। অন্তত ওর একটা হিল্লে হচ্ছে তো হোক!
খুব ভালো করেছেন, এতে সমস্যা কি?
কুহেলির মাসী আমতা আমতা করে বলল- গত কাল রাত থেকে কুহেলি বেপাত্তা!!!
কি বলছেন? কোথায় গেছে?
গত কয়েক দিন ধরে মন মরা ছিল, কারোও সাথে কথাবার্তা সে রকম বলছিলো না। বিয়েটা নিয়ে মানসিক চাপে ছিল। বিয়ের প্রথম রাত থেকে ই ঝগড়া ঝাঁটি। পাত্র বিপত্নীক, একটি দশ বছর বয়সী মেয়ে আছে, দাদু দিদার কাছে থাকে। পরে জানতে পারলাম বহু মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, আগের বউ টা নাকি এই কারণেই আত্মহত্যা করে ছিল। আমাদেরই ভুল হয়ে গেছে, ওকে আমরাই নরকযন্ত্রণা য় ঠেলে দিয়েছি।কথাবার্তা ও খাওয়াদাওয়া প্রায়ই ছেড়ে দিয়ে ছিল। গতকাল রাত তিনটে নাগাদ উঠে বাড়ি থেকে ফেরার। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল আমাদের সকলের।
বলছিলাম কি ......?
আর বলতে হবে না...কুহেলি আমার এখানে আসে নি। যদি বিশ্বাস না হয় স্বশরীরে দেখে যেতে পারে ন।  বলেই যতীন বাবু উদাস হোয়ে গেলেন।
সব কিছুই উলটপালট, মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো, কাঞ্চন কে নিয়ে এক সমস্যা ছিল, ওদিকে কুহেলি আবার হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ছেড়েছে। এতদিন বিষয়টি পাঁচকান হইনি, অফিস, পাড়া ও দুই পরিবারের মধ্যেই সীমিত ছিল। দুই মেয়ের এমন কীর্তি ও এমন মুখরোচক কাহিনী দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে আর দেরি হবে না, মিডিয়া চ্যানেলগুলো এমন সব খবরের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। রিপোর্টার নিশ্চিত তেল, মশলা, আচার দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদে পরিবেশন করবে, চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চালানো হবে, আর লোকে ভালো ভাবেই গিলবে। এরপর সমাজে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। এমন সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো। কুহেলি র বাবার ফোন।
দাদা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল, রাত থেকে মেয়েতার কোনও খোঁজ খবর পাচ্ছি না, কি করি কিছুই মাথায় ঢুকছে না ।
যতীন বাবু মনে মনে হাসলেন, একই বলে সময়ের প্রহার!!! দু দিন আগেই এই লোকটার কথা বার্তায় ভিন্ন সুর আর আজ ঠিক উল্টো।  তিনি নিজেও বাবা ও ভুক্তভোগী, সুতরাং রাগ করলে চলবে না, নইলে তার ও কুহিলির বাবার মধ্যে কি তফাৎ?
খুব শান্ত সুরে যতীন বাবু বললেন --কুহেলি র  অফিসে কাউকে জানান নি তো?
বেশ, না জানানোই ভালো, সেখান থেকেই পাঁচ কান হওয়ার চান্স বেশি!
আর থানা পুলিশ করেন নি তো?
কি যে বলেন মশায়, মুখ পুড়বে না।
সে জন্যই জিজ্ঞেস করছিলাম।
কুহেলির সঙ্গে যোগাযোগ হলে আপনাকে জানাবো।
আচ্ছা যতীনবাবু! কুহেলির মাসি কি ফোন করেছিল?
হ্যাঁ। উনার মুখে ঘটনাটি বিস্তারিত জানলাম।
দাদা প্লিজ, সাহায্য করুন, আমরা কি করবো কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।
আপনি চিন্তা করবেন না, আমিও খোঁজ খবর নিচ্ছি, কোনও তথ্য পাওয়া গেলে জানাবো বলেই যতীন বাবু ফোন কেটে দিলেন।
রমা ও রমা.....
বল দাদা....
বস এখানে।
আবার কিছু হলো নাকি?
কাঞ্চন কি এখনও ঘুমোচ্ছে?
হ্যাঁ দাদা।
শোন.…....যতীন বাবু সমস্ত ঘটনাবলী শোনালেন।
ঠাকুর...কি সব ঘটছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। দাদা এবার কি হবে।?
কি হবে না হবে আমিও জানি না। তবে আমাদের কেও একটু সেলফিশ হতে হবে। কাঞ্চনের কানে যাতে কোনরকমে খবরটা না যায়, নইলে সর্বনাশ। পরবর্তী তে কি করবে বলা মুশকিল। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওযা পর্যন্ত অফিসের কারোর সাথে যেন যোগাযোগ না করতে পারে, চোখে চোখে রাখবি, বিশেষ করে মোবাইল টার উপর। হইতো অফিসের কেউ বিষয়টি ফস করে বলে ফেলবে।
বুঝলি?
কোনও চিন্তা করো না দাদা, সব ম্যানেজ করে নেব-  বলে পিসি কাঞ্চনের ঘরের দিকে গেল।
কাঞ্চন উপুড় হয়ে বেহুঁ শ হয়ে ঘুমোচ্ছে। পিসি পাশে বসে মা মরা মেয়েটাকে সস্নেহে দেখতে লাগলেন, খুব ইচ্ছে করছিল মাথায় ও গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, হাত বাড়িয়ে ও সরিয়ে নিল, যদি ঘুম ভেঙে যায়।
ঘুমোক....।
পর্ব-- ৬
ধীরে ধীরে কাঞ্চন সুস্থ হয়ে উঠছে ও মানসিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল, তবে কিছুই বলা যাবে না, ডাক্তার জামিল পই পই করে জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও রকমের মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখতে হবে, এই ধরনের রোগীর সাথে যত বেশি বেশি, সময় কাটানো যায় ও পজিটিভ কথা বার্তা বলে মোটিভেটেড করা যায় ততই ভালো, ওষুধের ছেয়েও বেশি কার্যকরী। যতীন বাবু ও পিসি  ডাক্তার বাবুর পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন। ডাক্তার জামিলের পরিচিত সাইক্রতিস দু এক দিন অন্তর অন্তর একবার করে দেখে যাচ্ছেন। মোটের উপর রোগীর অবস্থা সুস্থতার লক্ষণ ভাল।
দিন দশেক পর কাঞ্চন বাবাকে ডাকল। যতীন বাবু পাশে বসে, কাঞ্চনের মুখের দিকে তাকালেন।
বল.....
বাবা, আমি ওই অফিসে আর চাকরি করবো না। আমি আজকেই পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিতে চাই।
যতীন বাবু একটু সময় নিয়ে বললেন-- তুই চিন্তা ভাবনা করে বলছিল, না হঠকারিতা য় অন্য কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিস।
না বাবা আর চাকরি করতে ইচ্ছে করে না।
ঠিক আছে, ইচ্ছে না থাকলে করবি না। তবে এ বিষয়ে একবার আজ  সন্ধ্যায় তোর জামিল কাকু এলে কথাবার্তা বলে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিস।
কাঞ্চন মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো। কিছুক্ষন বসে থাকার পর যতীন বাবু উঠতে লাগলেন, কাঞ্চন বাবার হাত ঝপ করে ধরে ফেলল।
যতীন বাবু কাঞ্চনের দিকে বিশ্বয়ের চোখে দেখা মাত্রই কাঞ্চন শান্ত সুরে বলল, কুহেলির কোনও খোঁজ খবর পাওয়া গেছে?
বিষয়টি যতীন বাবুর বোধগম্য হচ্ছে না, বর্ধমান গিয়ে বিয়ে করার পর কোনও খবাখবরের কথা বলছে না অন্য কিছু!!
যতীন বাবু ফ্যাল ফ্যাল করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কি ভাবছো বাবা, কাঞ্চন হেসে উঠলো।
সত্যি বাবা, তুমি পারো বটে!!!
কেন রে আমি কি করলাম।
আমি সব জানি বাবা, কুহেলির মাসি প্রথমে আমাকে ফোন করে ছিল তুলিনি বলে মেসেজ করে ছিল।
আমি জানতাম, সে ভুল ডিসিশন নিয়েছে, অমন বাজে পাত্রের সঙ্গে তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়া ঠিক হইনি।
তুই জানিস!!!!
বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আজ বুঝতে পেরেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা তুমি, তোমাকে বুঝতে আমি ভুল করেছি, বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
যতীন বাবু বহুক্ষণ ধরে মেয়েকে প্রাণ ভরে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ছোট্ট বেলায় কিছু একটা হলেই কাঞ্চন বাবাকে এমনি করেই জড়িয়ে ধরতো। যত আবদার, অনুযোগ, রাগ সবই বাবার উপর দিয়ে যেত, সেই মেয়েই ধীরে ধীরে একদিন বাবার থেকে দূরে সরে গেল। যতীন বাবুর চোখে জল। যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে আমার অযথা চিন্তা করে লাভ নেই।
কাঞ্চন হাত দিয়ে বাবার চোখের জল মুছে দিল।
প্লিজ বাবা কেঁদো না, আমি কথা দিচ্ছি, তোমার চোখে আর জল আসতে দেবো না।
যতীনবাবুর খুশির শেষ নেই। এতদিন বাদে মেয়ের সতবুদ্ধি হয়েছে এতেই খুশি।
দরজার পেছনে, পিসি নিশ্চুপে চোখের কোণের জল আঁচল দিয়ে মুছলেন।
পিসি, দূরে কেন? কাছে এসো।
ভগবান তোর মঙ্গল করুক মা।
কাঞ্চন হাসলো........আর মনে মনে বলল ভগবান সবারই মঙ্গল করুক।
কাঞ্চন ভাবতে লাগলো, সে কি সমকামী, না কিন্নর, কুহেলি র প্রতি তার ভালোবাসা ছিল, কিন্তু প্রেম? সে রকম অনুভূতি কোনও দিন আসে নি এবং ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেনি। কাঞ্চনের জীবনেও বসন্তের আগমণ হয়েছিল, প্রায় পাঁচ বছরের প্রেম ছিল কলেজে র দু বছরের সিনিয়র অয়নের সাথে, শান্ত শিষ্ট সত্যিকারের ভালো ছেলে, ক্লাস টপার, মানে খুবই মেধাবী ছাত্র। কুহেলি অবিশ্যি কোনও দিনই পছন্দ করতো না অয়নকে, তার মতো মেধাবী ছেলেরা ভালো বর কোনও দিন হতে পারে না, এরা সাধারণত মায়ের আঁচল ধরে বড়ো হয়, নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বলে কিছু থাকে না, অন্যের কথায় উঠে বসে বিয়ের আগে মা বাবার কথায়, বিয়ের পর বউয়ের কথায়। কুহেলির কথা শুনে কাঞ্চন শুধু হাসতো, অয়নের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তার মনে হতো অয়ন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অয়নের চোখের গভীরতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতো।
কুহেলির বিয়ের পর কাঞ্চনের জীবনে একাকীত্বর মেঘ ঘনিয়ে আসে এবং সেও বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলো। পিসি পই পই করে সাবধান করে দিতেন যা কিছু করবি খুব সাবধানে পা ফেলিস, কোনও কিছু গোপন করবি না। কাঞ্চনেরও মনে হয়েছিল বিয়ের আগে হবু বর অয়ন কে সব কিছুই খুলে বলবে তার শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে। নিয়তির রায় নির্ধারিত ছিল, খন্ডাবে কে? কুহেলি ই ঠিক ছিল, সব কিছু শোনা ও জানার পর অয়ন কোনও ভণিতা না করে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসলো, বিয়ে দুর থা, কাঞ্চনের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল। কাঞ্চন খুব শক্ত মেয়ে, বিষয়টি দৃঢ় তার সাথে পরিস্থিতি সামালে নিয়েছিল। তখনই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে আর কখনো বিয়ে করার কথা ভাববে না। পুরুষ জাতির উপর তার ঘেন্না জন্মে গেছে। পিসির মতই পরিস্থিতি র সাথে একাই মোকাবিলা করবে। ভেবেছিল কোনও এক অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত হবে, বাকিটা জীবন অনাথ আশ্রম আর চাকরি করে কেটে যাবে। ঠিক তখনই আরও এক বাজ পড়লো কাঞ্চনের মাথায়, যখন কুহেলি র ডিভোর্সে র কথা শুনলো।
ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল, অমন সুন্দরী মেয়ে, প্রাণচঞ্চলা, বন্ধু বান্ধবদের নয়ণের মণি। অতিরিক্ত হি হি করে হাসির জন্য পথে ঘটে অসস্থির সম্মুখীন হতে হয়েছে, বহুবার কাঞ্চন সতর্ক করেছে , একবার এই হাঁসির জন্য ক্লাস টিচার এর শাস্তির কবলে পড়ে তবুও মুখে হাসি ঝিলিক খেলে বেড়াতো। সেই কুহেলি যেন হাসতে ভুলে গিয়েছিল, অমন মেয়েটা  মা- বাবা , আত্বীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, অফিস এর সহকর্মী সকলের সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল, কাঞ্চনই ছিল একমাত্র অবলম্বন, সব কিছুই তার সাথে শেয়ার করতো, সুখ দুখ, ভালো মন্দ সব কিছুই। সেই কুহেলিকে সাইচড়াট্রাইক্স সইক্রতিস এর কাছে নিয়ে গিয়েছিল, নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে রেখে ওষুধ পত্র খাওয়ানো, দেখাশোনা, আদর যত্ন, সব কিছুই নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল। দু জনের মধ্যে সম্পর্ক এত ই বেশি মাখা মাখি হয়ে গিয়েছিল, সকলেই ভাবতে লাগলো এদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, নিষিদ্ধ সম্পর্ক, যাকে সমাজ কোনোদিনই মান্যতা দেই নি। কাঞ্চনকে আঁকরে  ধরে বাঁচতে চাইছিল, সেও পাশে থাকার অঙ্গীকার বদ্ধ ছিল। পিসি ছাড়া আর কেউ পাশে ছিল না, সকলেই ছি ছি করতে লাগলো, শেষে বাধ্য হয়ে কুহেলি নিজের বাড়ি ফিরে যায়, কিন্তু বাবাকে কোনও দিন ই বোঝাতে পারে নি, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের রসায়ন। নিজের জীবন বিপর্যস্ত, পিসির মত তারও দুর্গতি হোক সে কোনও দিন চাই নি, তাই তো বিয়ে থা ব্যাপারে বাবার বাড়াবাড়ি কে কানে তোলে নি। আশর্য নিষ্ঠুর সমাজ মাথা তুলে বাঁচার অধিকার টুকুও কেড়ে নিল, গায়ে সাটলো সমকামীর তকমা, সে তো কুহেলি কে কোনও দিন সেভাবে স্পর্শ করে নি, তার প্রতি কামুক ভাবও জন্মায় নি। কাকে আর কি বোঝাবে? নিয়তির খেলা ভেবে সবকিছুই মাথা নত করে সহ্য করতে হয়েছে।সেই থেকেই কুহেলির প্রতি তার আকর্ষণ, সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক আকর্ষণ। আর সেই আকর্ষণেই রঙ লাগাতে লাগলো সবাই। সে জানতো কুহেলি এই মানসিক চাপ বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না, নিশ্চিত এমন সিদ্ধান্ত নেবে, তাতে ক্ষতি তারই হবে।
কুহেলির দ্বিতীয় বিয়ের খবর পাওয়া মাত্রই মনে হচ্ছিল পুরো আকাশটা যেন তার মাথার উপর ভেঙে পড়েছে, সব কিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিল, কুহেলি এতো বড় সিদ্ধান্ত নিল, অন্তত এক বার জানাতে পারতো, কাঞ্চন ভেঙে পড়েছিল, মনে হচ্ছিল পুরো শরীরটা ক্রমে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। সে চাপ নিতে পারে নি, ফলস্বরূপ .......নিজের মানসিক রোগী। কাঞ্চন এর রাগ করেনি, খুবই দুঃখ পেয়েছে কুহেলির আচরণে।
কিন্তু কুহেলিটা এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল? কি এমন ঘটনা ঘটলো যে সে বিয়ের তিন দিনের মাথায় শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরার হল!!!!
পর্ব ৭
পরদিন সকাল সকাল ডাক্তার জামিল হাজির। বাহিরে হাঁক ডাক চলছে। কি হে যতীনদা কোথায় গেলে?
দাদা, এত সকাল সকাল? সব ঠিক আছে তো?বিশেষ প্রয়োজনে নাকি? এই সময় তো আসো না? অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে ।
আরে না হে বাপু!!!! সব বিষয়েই তোমার বাড়াবাড়ি।
আজকাল খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, সন্ধ্যায় আসার সময় পাবো না, তাই ভাবলাম একটা ঢুঁ মেরে আসি।
কাঞ্চন ঘুমোচ্ছে না কি?
হ্যাঁ, দাদা।
কেমন আছে?
মনে হচ্ছে ঠাকুরের আশীর্বাদে এ যাত্রা বেঁচে গেল।
ঠিকই বলেছো যতীনদা।
রমা পিসি দু কাপ চা দিয়ে সামনে বসল।
রমা তোমার কি মনে হচ্ছে?
পিসি ডাক্তার জামিল এর দিকে তাকিয়ে রইল, মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না।
মেয়েটাকে মোটেও বুঝে উঠতে পারছি না। সে কি চায়, কি না চায় , কোনও কিছুই মাথায় ঢোকে না। জামালদা, একবার কাঞ্চনের সমস্ত শরীরের টেস্ট করে দেখো না, যদি কোনও উপায় থাকে, কার ভরসায় রেখে যাবো ওকে? পিসির চোখে জল।অদূরে যতীন বাবুরও চোখ ছলছল করছে।
থাম রমা, সকাল বেলা মেজাজটা বিগরে দিস না। তবে তোর কথায় ওজন আছে। আমাদের মেডিকেল সায়েন্স অনেক মিরাকল ঘটছে, কাঞ্চনের ক্ষেত্রে যদি কিছু করা যায় কিনা ভাবতে হবে, বিদেশে অকছার নিত্য নতুন টেকনোলজির মাধ্যমে অসাধ্য সাধন হচ্ছে, হয়তো এখানেও সম্ভব। আমাদের দেশেও সম্ভব, তবে অনেক ব্যয়বহুল। সব কিছুর ডোনার চাই, তার পরে ট্রান্সপ্লান্ট, অনেক ঝামেলা, তারপরে গ্রহীতার শরীর কিভাবে রিয়্যাক্ট করে তার উপরই সবকিছু  নির্ভর করে। বিষয়টি আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখছি কি করা যায়।
কথাগুলো বলার পর ডাক্তার জামিল, দুজনেরই মুখের দিকে তাকালেন, উভয়ের নিঃশ্চুপ, কেউই রা কারছেন না।
যতীনদা, রমা কিছু বলছো না যে?
যতীন বাবু ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে?
ডাক্তার জামিল পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কাঞ্চনকে  দেখতে পেলেন। আয় মা তোর ব্যাপারেই আলোচনা করছিলাম।
আমি পুরোটাই শুনে নিয়েছি কাকু। আপনি নতুন করে বাবা ও পিসির চক্করে পড়বেন না, আমি ঠিক আছি, ওসব কিছু করার আমার ইচ্ছে নেই। যা আছি বেশ আছি - বলেই কাঞ্চন চুপ করে গেল।
আমরা তো সবাই জানি তুই খুব ভালো আছিস, আমরা চাই তোকে আরও ভালো রাখতে।
না পিসি অন্তত তুমি আর এ বিষয়ে আর নাক গলিও না, কেন তোমরা নতুন করে ঝামেলা পাকাচ্ছো? ট্রান্সপ্লান্ট করে কি লাভ হবে? যত সব পাগলের দল......গজ গজ  করতে করতে কাঞ্চন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে, পিসির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, আমি জাস্ট দরজা বন্ধ রাখছি, ডাকাডাকি শুরু করো না, মাথাটা চেপে ধরেছে তাই কিছুক্ষণ একলা চুপ চাপ শুয়ে থাকতে চাই। কাঞ্চন পুনরায় দরজা বন্ধ করে দিল।
ডাক্তার জামিল, যতীন বাবুর দিকে চেয়ে কাছে ডেকে কানে কানে বললেন, আগে ও মানসিক দিকটা সামলে নিক, তার পরে দেখা যাবে কি করা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
আবার সজোরে দরজা খোলার শব্দে সকলেই সেদিকে দেখলেন।
কি ব্যাপার, ক্যাবিনেট মিটিং শেষ না স্থগিত!! আলোচনা বন্ধ কেন করলেন আপনারা?
সকলেই চুপ, পরিস্থিতি থমথমে।
কাঞ্চন হো হো করে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল, কোনও রকমে সামলে ডাক্তার জামিলের মুখের দিকে তাকাল, মুখটি একেবারেই লাল হয়ে গেছে, বাবা ও পিসির অবস্থাও শোচনীয়। মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষ শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে মান সন্মান সব ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
উঠছি যতীনদা।
কাঞ্চন ঝপ করে ডাক্তার জামিলের হাত টেনে পুনরায় বসালো। কাকু কেমন দিলাম সকাল, সকাল! মুখে দুষ্টুমির হাসি।
ও বুঝেছি তুমি ইচ্ছে করে ওসব করছিলে।
হ্যাঁ কাকু, সকাল সকাল আপনাদেরকে গোপন আলোচনা করতে দেখে ভাবলাম, আমিও একটু মজা করি।
এটা মজা করার বিষয়.... যতীনবাবু কটমট করে কাঞ্চনের দিকে তাকালেন।
রিলাক্স বাবা, রিলাক্স, টেনশন করো না। টেনশনে করলে তোমাকে ধৃতরাষ্ট্র মনে হয়, অসহায় বেচারা টাইপের।
ঠিক আছে করছি না, কিন্তু কার সাথে মজাক করছো, সেটা তো দেখবে। আমরা কি মজাক করার পাত্র।
এতক্ষণে ডাক্তার জামিল কিছুটা ধাতস্থ হলেন, যাই বলিস না তুই, আমার বিষয়টি সিরিয়াস মনে হচ্ছিল।
না, কাকু মোটেও না। আমি সত্যি বলছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। সবাই একসঙ্গে পুনরায় চা খাওয়া শেষ করলেন, অনেকদিন পর বাড়ীর সকলে একসঙ্গে বসে প্রাণ খুলে গল্পগুজব করল।
চা পর্ব শেষে ডাক্তার জামিল উঠে গেলেন, হাত ঘড়িতে সময় প্রায় সাড়ে সাতটা, অনেক দেরি হয়ে গেছে, এই সময় তিনি তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
পর্ব ৮
বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা, দুপুরের খাবার খাওয়া শেষে কাঞ্চন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ম্যাগাজিনের পাতা উলট পালট করছিল, পাতায় ধ্যান নেই, শুধু ছবিগুলো দেখছিল, এমন সময় কলিং বেলটি বেজে উঠলো। বাবা ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট নিতে বেরিয়েছেন।  এই সময়টাতে পিসি ঘুমোয়, সারাদিনের খাটাখাটির পর একটু ঘুম গোছের বিশ্রাম। কাঞ্চন ভাবলো পিসি শুয়ে আছে, থাক তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলে দেখল গ্রিলের ওপারে আগন্তুক, বছর পঁচিশের মহিলা, কপালে সিঁদুর, মানে বিবাহিতা, পড়নে সালোয়ার কামিজ, কোনও রকম সাজুগুজু নেই নিতান্তই সাদামাটা গোছের। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চুলও এলোমেলো হয়ে আছে, কাঞ্চন মহিলাকে দেখেই বুঝতে পারল উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে।
ভদ্রমহিলার নমস্কারের প্রতি উত্তরে কাঞ্চন হাত জোড় করল বলল - বলুন।
এটা কি যতীন বাবুর বাড়ী?
হ্যাঁ বলুন।
আপনি কি কাঞ্চন?
কাঞ্চন একটু অবাকই হল। মহিলা নিশ্চিত খোঁজ খবর নিয়ে এ বাড়িতে এসেছেন।
কেন কি ব্যাপার?
আমার নাম সুলেখা দাস, কলকাতার মেয়ে, দুর্গাপুরে থাকি স্বামীর কর্মস্থলে।
সে ঠিক আছে, কিন্তু কি কারণে এখানে এসেছেন তা তো বুঝতে পারছি না।
আমি অয়নের স্ত্রী। আমি কি ভেতরে আসতে পারি? কিছু কথা বলার ছিল।
কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না।
সত্যি সত্যি আমি অয়নের স্ত্রী, এই ফটোটা দেখলে বুঝতে পারবেন।
কাঞ্চন ফটোটা হাতে নিয়ে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো এবং বেশ কয়েকবার দেখার পর আস্বস্ত হল। আজকাল এই কলকাতা শহরে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, কি জানি কার কি মনে আছে। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়, এই ভয়ে কেউ কোনও আগন্তুকে সরাসরি ঘরে ঢুকতে দেয় না। অভদ্রতা, সৃষ্টাচারের বিরুদ্ধে, বাঙালিদের গতানুগতিক পরম্পরার বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক সত্যিটা সত্যিই।
কাঞ্চন গ্রিলের তালা খুলে, মহিলাকে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে বলল।
এক গ্লাস জল খাওয়াবেন?
নিশ্চয়। বসুন, আমি আসছি।
পিসি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছেন। কাঞ্চনকে জিজ্ঞাসা করলেন কে এসেছে?
অয়নের স্ত্রী.....।
পিসি বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন - কেন এসেছে?
জানি না।
ও!! বস গিয়ে, আমি জল দিচ্ছি।
কাঞ্চন ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখল, মহিলা সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
কাঞ্চনকে দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
বসুন বসুন।
ইতিমধ্যে পিসি একগ্লাস জল ও মিষ্টি সেন্টার টেবিলে রাখলেন।
জল খান, কাঞ্চন জলের গ্লাস ও মিষ্টির প্লেট সামনে এগিয়ে দিল।
জল খাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ, শোঁ শোঁ করে ঘোরা ফ্যানের শব্দ কানে বাজছে ।
কাঞ্চন নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল- কিছু বলছিলেন আপনি?
ও হ্যাঁ, আমি অয়নের স্ত্রী।
সে তো আগেই শুনেছি, কিন্তু এখানে কেন?
আমাদের বিয়ে বছর খানেক আগে হয়েছে, বিয়ের পর সবকিছুই ঠিক ঠাক চলছিল, কিন্তু বিয়ের দু মাসের মধ্যে আবিষ্কার করলাম ও নেশাগ্রস্ত। আমার  দাম্পত্য জীবনে অভিশাপ নেমে আসে যেদিন শুনলাম মোলার প্রেগন্যান্সির কথা। বাবা মায়ের 46জোড়া ক্রোমোজোম নিয়ে গঠিত হয় ভ্রূণ, সে ভ্রূণ উত্তরাতর বৃদ্ধি পায় জরায়ুতে, মায়ের দিক থেকে আসা 23 জোড়া ক্রোমোজোমে সমস্যা থাকলে  পুরুষের দিক থেকে আসা ক্রোমোজোম দিয়ে যে অপূর্ণ ভ্রূণ তৈরি হয় পরবর্তীতে অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে যাকে সিস্ট বলে। এই সিস্ট মেয়েদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে, মেডিক্যাল সায়েন্স এই অপূর্ণ ভ্রূণ হল মোলার প্রেগন্যান্সি। প্রথম দিকে কথা কাটাকাটি, ঝগড়া পর্যন্ত ঠিক ছিল, বিয়ের আট মাসের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কথায় কথায় গালিগালাজ, অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ কোনো কিছুই বাকি রাখে নি।কিন্তু আমার ধর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন সে প্রথম বার হাত তোলে। তারপর থেকে মোটামুটি কথাবার্তা বন্ধ, শুধু এক ছাদের তলায় থাকছিলাম। গত মাসে একদিন রাতে গলা পর্যন্ত মদ গিলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো আর এক নাগাড়ে নিজের মা বাবা ও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। সেদিনই প্রথম আপনার নামটা জানতে পারলাম, মায়ের জন্যই নাকি আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বুঝতে পারি সে আপনাকে এখনও ভালবাসে। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই গত এক মাস ধরে ও নিখোঁজ,  কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ডায়েরিতে আপনার নাম ঠিকানা দেখে ভাবলাম এক বার খোঁজ খবর নিয়ে আসি।
ও এই ব্যাপার! অয়নের সাথে আমার প্রেম ছিল আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু সে আমাকে কেন প্রত্যাখ্যান করেছে বলেনি?
মহিলা না সূচক মাথা ঝাঁকালেন।
তবে থাক শুনে লাভ নেই। কাঞ্চন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আপনার দেখে শুনে বিয়ে করা উচিৎ ছিল।
ঠিক বলেছেন। ওর ডায়েরিতে আরও একটা নাম খুঁজে পেয়েছি - কুহেলি। সে কে, আপনি চেনেন?
হ্যাঁ আমার বন্ধু।
ও!!! এই কি কুহেলি? একটা পোস্ট কার্ড সাইজের ফটো কাঞ্চনের দিকে এগিয়ে দিল।
কাঞ্চন চমকে উঠল, ফটোতে সাথে অয়ন এবং ঘনিষ্ঠ অবস্থায় তোলা, দেখা মাত্র মাথা ঘুরে গেল। কই কুহেলি তো এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি?সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, হিসেব পত্তর কিছুই মিলছে না।চিন্তা ভাবনা বুদ্ধি সব কিছু লোপ পেতে শুরু করেছে।  কুহেলি কখনোই কাঞ্চন ও অয়নের প্রেম সহজ ভাবে নেইনি। তবে কি কলেজে অয়ন  ও কুহেলির গোপন প্রেম ছিল। এতই বোকা কাঞ্চন যে কিছুই বুঝলো না। হয়তো অয়নের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে কুহেলির প্রথম বিয়েটা ভেঙে গেছে?
কাঞ্চনদি এইটা দেখো!
কাঞ্চন হাতে নিয়ে দেখলো কুহেলির দ্বিতীয় বিয়ের ফোটো, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই ফটোতেও অয়ন উপস্থিত, যেমনটি ছিল প্রথম বিয়েতে। কুহেলি ও অয়নের রসায়ন এখন জলের মতো পরিষ্কার।
অজান্তেই কাঞ্চন চিবুকে হাত দিয়ে কিছু ভাবতে লাগলো, এবার হিসেব নিকেশ মিলতে শুরু করেছে। কুহেলি ও অয়ন প্রায় একই সময়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। একজন বউকে ছেড়ে তো একজন স্বামীকে ত্যাগ করে। বাহ! রে ভগবানের লীলা-খেলা , এতো সিনেমার গল্পকেও টেক্কা দেবে। নায়কের চরিত্রটি অসাধারণ, মায়ের আঁচল টেনে ধরে চলা মেরুদন্ডহীন ছেলে, কলেজে প্রেম একজনের সাথে, মায়ের ভয়ে প্রেম প্রত্যাখ্যান, বিয়ে মায়ের পছন্দের পাত্রীকে অবশেষে কাহিনীতে নাটকীয় মোড়, কলেজের প্রাক্তন প্রেমিকার বান্ধবীর সাথে গোপন প্রেম ও বিবাহিতা সেই প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। জমজমাট চিত্রনাট্য।
তবুও মন মানে না, কুহেলি কি শেষপর্যন্ত এই? বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মন্থনে মনের অবস্থা শোচনীয়। কি সত্যি আর কি মিথ্যে ভগবানই জানেন। আর যদি সত্যি হয় সে কুহেলিকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারবে না।
সামনে বসা মহিলাটির উপর দয়া কয়েকগুণ বেড়ে গেল, প্রথম বার কুহেলির সাথে ঘটা পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি কিন্তু এবারে কাঞ্চন খুব সাবধান, সে চাই না কুহেলির মত সুলেখাকে নিয়েও একটি মুখরোচক গল্প তৈরি হোক!!
কাঞ্চন সুলেখার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ও স্বাভাবিক সুরে বলল- কিন্তু আমার কাছে কেন এসেছেন?
যদি কিছু খবর পাওয়া যায় এই আশায়।
না আমার কাছে কোনও খবর নেই, অয়নের সাথে কলেজের পর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আর কুহেলির সাথে বিগত এক মাস কোনও যোগাযোগ নেই।
আপনার শশুর বাড়ী থেকে কোনও খবরাখবর পান নি?
মনে হয় ও বাড়িতে সকলেই সবকিছুই জানে। উল্টে শাশুড়ি আমাকেই দোষারোপ করছেন, আমার জন্যই নাকি অয়নের এই অবস্থা। এমন কি মানসিক অত্যাচারের ধমকি দিয়ে থানায় আমার নামে অভিযোগ জমা দিয়েছে। ও বাড়ির দরজা আমার জন্য বন্ধ।
আর আপনি কিছুই করেন নি?
কি করবো কাঞ্চনদি, যা কিছু করার এভাবেই একা একা ছুটে বেড়াচ্ছি, যদি কোন সন্ধান পাওয়া যায়।
শুনুন আপনি দুর্গাপুরে একটি থানায় মিসিং ডায়েরি করে রাখুন।
করেছি।
ও! 498 এর একটা কেস করে রাখুন।
তাহলে তো দিদি আমার জন্য সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
সেটাও ঠিক।
কাঞ্চন আরও কিছু বলার চেষ্টা করতেই পিসি
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সুলেখার সামনে দাঁড়ালেন এবং সুলেখাকে সম্মোধন করে বললেন- শোন মা, তোমার সাথে যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য খুবই দুঃখিত। হাতজোড় করে বিনতি করছি এই বিষয়ে আর কাঞ্চনকে না ঘাটানোই ভালো, ও অসুস্থ, মানসিক চাপ নিতে পারবে না।
সুলেখার মুখে শুকনো হাঁসি। ঠিক আছে পিসি কথা দিলাম তবে একটি অনুরোধ আছে!
বলো।
এই কাগজটি রাখুন , আমার মোবাইল নাম্বার।
ও বুঝেছি, দাও কিছু খবর থাকলে অবশ্যই জানাবো, বলেই পিসি কাগজের টুকরোটি চিলের মত ছোঁ মেরে তুলে নিলেন।
কাঞ্চন পিসির কীর্তি দেখে মনে মনে হাসলো। ভাগ্যিস বাবা বাড়িতে নেই, নইলে উনি যে কি করতেন!!
আসি পিসি, আসি কাঞ্চনদি।
নমস্কার প্রতি নমস্কারের পর সুলেখা চলে গেল।
পিসি ও কাঞ্চন বোবার মত  টিভির সামনে চুপচাপ বসে আছে, কাঞ্চন ক্রমাগত চ্যানেল বদলে যাচ্ছে।
এভাবে প্রায় মিনিট দশেক বসে থাকার পর কাঞ্চন মৌনতা ভেঙে বললো- আচ্ছা পিসি তোমার কি মনে হচ্ছে?
দেখ মা তুই কুহেলিকে ভুলে যা, ওই নাম টা আর শুনতে চাই না। বাপরে বাপ, সাত জন্মেও এমন কুলক্ষণে মেয়ে দেখিনি। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা, আর কি কীর্তি করবে কি জানি?
পিসি এসব মিথ্যেও তো হতে পারে!!
তোকে আর ওকালতি করতে হবে না। পিসি কাঞ্চনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, মা আর পাগলামি করিস না, বাদ সেসব, কে কি করছে ওসব চিন্তাভাবনা বাদ দে, শুধু নিজের কথা ভাব। তোর বাবা যদি আজকের ঘটনা শুনে তোর বাবার কোনো অঘটন না ঘটে যায়।
এই জন্যই তো চুপচাপ আছি পিসি। আর না অনেক হয়েছে!!
ঠিক বলেছিস। পিসি পুনঃ কাঞ্চনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ও কপালে চুমু দিলেন। কাঞ্চনও পিসিকে সজোরে জড়িয়ে ধরলো।
পর্ব - ৯
সপ্তাহ খানেক পর বেলা 11টার দিকে কাঞ্চনের মোবাইলে একটা মিস কল এলো। মিস কল দেখলেই এমনিতে কাঞ্চনের মেজাজ বিগড়ে যায়, কিন্তু আজ কি মনে করে কাল ব্যাক করলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রিং বেজে গেল কিন্তু ওপর প্রান্তে কেউ তুললো না। পরপর দু বার কেউ কল রিসিভ করলো না। কাঞ্চন আর চেষ্টা না করে ফোন সাইলেন্ট মোডে করে স্নান করতে গেল, আগে অফিস বেরোনোর তাড়া থাকতো, কোনোরকমে পড়ি মরি করে কাক ভেজা স্নান সেরে অফিসের জন্য দৌড় লাগাতে হতো আর এখন সাথে অঢেল সময়, তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। মিনিট কুড়ি পর বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে 19টি মিস কল। মিসকল কর্তা/কর্তী একটা মেসেজও পাঠিয়েছে।
"আমি সুলেখা, অয়নের খোঁজ পেয়েছি, রাঁচিতে আছে"।
কাঞ্চন ভাবতে লাগল, সুলেখা কি করে তার ফোন নাম্বার জোগাড় করল, সর্বনাশ! মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, এই মেয়েটাও মনে হচ্ছে ডুবাবে!  ইগনোর কাঞ্চন ইগনোর।
মেসেজটি পড়ার পর কাঞ্চন ফোনটি বিছানায় রেখে প্রসাধনীতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
প্রসাধনী শেষে ধীরে পায়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো, পিসি রান্না বান্নায় ব্যস্ত, পিসি কি রান্না করলে?
সে রকম কিছু না রে। শরীরটা আজকে ভালো যাচ্ছে না।
সে কি পিসি তুমি আগে বললে না।
বললে কি করতি? রান্না বান্না না করলে খাবি কি?
পিসি যাও তুমি বিশ্রাম করো, বাকি রান্না আজ আমি করবো। রান্না ঘর থেকে একপ্রকার টেনে বের করল।
কাঞ্চন পাগলামি করিস না। তুই পারবি না।
দেখি পারি কি না।
ভয় পাচ্ছ না পিসি?
কিসের ভয়?
আমার রান্না তোমাদের মুখে রুচবে কি না !!
তোকে পারবো না।
পিসি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল, মাথাটা বন বন করে ঘুরছে। কি জানি প্রেশার কমে গেল নাকি?
কিছু লাগবে পিসি? পেছন পেছন কাঞ্চন কখন ঘরে ঢুকে গেছে বুঝতেই পারে নি।
এক গ্লাস নুন-চিনি জল নিয়ে আয়।
নুন-চিনি জল খেয়ে পিসি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা বাড়তে লাগল কি জানি কাঞ্চন ওদিকে কি করছে ?
আধঘণ্টা পর কাঞ্চন পিসির ঘরে উঁকি মেরে দেখে পিসি ঘুমোচ্ছে, এদিকে বাবার আসার সময় হল। ঝটপট রান্না ঘরের কাজ শেষ করে নিপুণ ভাবে সবকিছু ধুয়ে মুছে ঠিকঠাক করে সাজিয়ে  রাখলো।
নিজের ঘরে ঢুকে মোবাইল টি হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করতে লাগলো। না সুলেখার কোনও মেসেজ নেই।
কাঞ্চন সুলেখার মেসেজের উত্তরে লিখলো, " বেস্ট অফ লাক"। ফোন করা বা আর কিছু জানার আগ্রহ নেই, সুতরাং বিষয়টিকে এখানেই ইতি করা শ্রেয় মনে হলো।
পিসি খুব খুশি। কাঞ্চন এতো আগ্রহের সাথে প্রথম বার রান্না করেছে, খুশি হওয়ারই কথা। বাবা বাকরুদ্ধ। খুশিতে কান্নাকাটি না শুরু করে দেন। কিন্তু বাবা বিশেষ কিছু না বলে ডাক্তার জামিল সাহেবকে ফোন ধরলেন ও রান্নাবান্নার ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন।
বাবা কাঞ্চনকে ডেকে বললেন , একমুঠো ভাত চাপিয়ে দে মা, তোর জামিল কাকু আসছেন!!
বাবা তুমিও না!!!
না রে খুব ভালো রান্না করেছিস।
আধ ঘন্টা পর ডাক্তার বাবু সোজা ক্লিনিক থেকে হাজির। কোনোরকমের কথা ব্যয় না করে ভাত বেড়ে দিতে বললেন। কাঞ্চনও বাধ্য মেয়ের মত প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করল। ডাক্তার কাকু তৃপ্ত সহকারে চেটে পুটে খেলেন এবং শেষে এক মস্ত বড় ঢেঁকুর তুললেন। কাঞ্চন লজ্জা পেয়ে পিসির পেছনে লুকিয়ে গেল।
আসি যতীন দা। তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার জামিল বেরিয়ে গেলেন।
কাঞ্চনের খুব রাগ হল, কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা অন্ততঃ দু একটা প্রশংসা সূচক কথা বলে যাওয়া উচিৎ ছিল।
বাড়ি থেকে অদূরে গিয়ে ডাক্তার জামিল যতীন বাবুকে রিং করলেন। অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো শব্দ, শুনেই জামিল সাহেব বললেন যতীনদা যা বলছি শুধু শুনে যাও, প্যানিক হবে না।
শোন, কাঞ্চনের আচরণ ও লক্ষণ কিন্তু স্বাভাবিক আমাকে ঠেকলো না, রান্না বান্না করা, খুশি থাকা দেখানো, বড় ধরনের সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রমাকে বুঝিয়ে বলবে ওকে চোখে চোখে রাখতে, ওর সাথে সহজভাবে মিশে ওর মনের কথাগুলো বের করতে হবে। আমি নিশ্চিত ও কিছু লুকোচ্ছে। বিগত কয়েক দিনের ঘটনাবলীর কথা রমার থেকে খুব সাবধানে জানার চেষ্টা করো - সামথিং ইজ রং। সন্ধ্যায় সময় পেলে একবার আসবো। রাখছি বলে ডাক্তার জামিল ফোন কেটে দিলেন।
যতীন বাবু, নতুন করে সমস্যায় পড়লেন, দুপুরে কাঞ্চনের রান্না বান্নার করেছে খুশির অন্ত ছিল না। যাক ঠাকুরের অশেষ কৃপায় কাঞ্চন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে, কিন্তু ডাক্তার জামিলের কথা গুলো সব তালগোল পাকিয়ে দিল। বহু অভিজ্ঞ ডাক্তার, উনার পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, গম্ভীরতার সাথে পর্যালোচনা করাই ভালো।
রাতের দিকে যতীন বাবু কুহেলির বাবাকে ফোন দিলেন।
নমস্কার যতীন বাবু!
নমস্কার।
হঠাৎ এ সময়ে ফোন, সব ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক।
কুহেলির কোনও খোঁজ খবর পাওয়া গেছে?
ওপ্রান্তের উত্তরদাতা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন-হ্যাঁ।
এখন কোথায় সে ? কই আমাদের জানালেন না।
রাঁচিতে। কি করে জানাবো দাদা, লজ্জার কথা, কুলাঙ্গার মেয়ে অয়ন নামে কলেজের এক সিনিয়রের সাথে পালিয়েছে। মুখ দেখানোর আর জায়গা নেই দাদা। আমার একুল ওকুল দুকূলই গেল, ঘটনাটি জানার পর ঘরবন্দি। শুনেছি অয়ন আবার বিবাহিত। সে ব্যাটাও বউ ফেলে পালিয়েছে। আসলে বর্ধমানে দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে অয়নের সাথে দেখা, সেখানে থেকেই পুনঃ যোগাযোগ তাদের আর কুলাঙ্গার মেয়ে আমাদের মুখে চুন কালি লেপে চলে গেল।
আচ্ছা দাদা একটা কথা জানার ছিল?
বলুন যতীন দা।
কাঞ্চন কি কিছু জানে এই বিষয়ে।
আমরা তো কেউ জানায় নি, তবে হ্যাঁ গতকাল অয়নের স্ত্রী খুঁজতে খুঁজতে বাড়িতে হাজির। খুব কান্নাকাটি করছিল, বাধ্য হয়ে ওকে কুহেলির মা সব কথা বলে ফেলেছে। কাঞ্চনের ফোন নাম্বারটি খুব সম্ভবত নিয়ে গেছে।
কেন কাঞ্চনের কাছে ফোন টোন এসেছিল নাকি?
না , তবে যেকোনো সময় আসতে পারে। রাখছি দাদা বলে যতীন বাবু ফোন কেটে দিলেন এবং ফোন কেটে বেশ কিছুক্ষণ সোফায় গুম মেরে বসে থাকার পর ডাক্তার জামিলকে ফোন করে বিস্তারিত জানালেন।
ফোনের ওপার থেকে ডাক্তার জামিল বললেন কাঞ্চন কে দেখেই আমার সন্দেহ হয়। যাই হোক না কেন খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে, নইলে হিতে বিপরীত হতে পারে, একের পর এক মানসিক ধাক্কা সামলে ওঠা খুব মুশকিল হবে।
যতীনদা তাড়াহুড়ো করো না কাল সকালে সাক্ষাতে কথা হবে, পারলে রমার সাথে কথা বলো।
ডাক্তার জামিল ফোন কেটে দিলেন।
যতীন বাবু বেশ কিছুক্ষণ জানালার পর্দা সরিয়ে তারাহীন রাতের আকাশটাকে দেখতে লাগলেন, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা লম্বা টান শেষ করলেন। 
রাতে আর ঘুম আসে না, বহুক্ষণ ছটপট করার পর অগত্যা একটা 5mg খুমের ট্যাবলেট খেলেন ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম এসে গেল। সকাল সকাল বিছানা ত্যাগ করার অভ্যাস, এদিনও ব্যতিক্রম হলো না, ভোরের দিকে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে দেখে কাঞ্চন ধবধবে সাদা পোশাক পরে বার্বি ডলের মত সুন্দর দেখছিল ও রথের ভেলায় চেপে আকাশে উড়তে উড়তে হারিয়ে যাচ্ছে।  ধড়পড় করে উঠে কাঞ্চনের বেডরুমে র দরজাতে আলতো চাপ দিয়ে দেখে ভেতর থেকে বন্ধ ও কাঞ্চনের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। যতীনবাবু কিছুটা আস্বস্ত হলেন ও প্রাত ভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন।
পর্ব ১০

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !