ঘটি ও বাঙাল

এডমিন
0




 

জ্ঞানবোধ হওয়ার পর থেকেই ঘটি-বাঙালি নিয়ে পরস্পরকে নিয়ে রসিকতা শুনে আসছি। বিশেষ করে কোলকাতার অলিতে গলিতে চায়ের ঠেক থেকে হাটবাজার, চোলাই মদের আসর থেকে পাব, ভিক্টোরিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট, লোকাল ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভিড়ের মাঝে, ফুটবলের ময়দান থেকেই রাজনীতির আঙিনা সর্বত্রই ঘটি-বাঙালিদের নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা নিত্য দিনের সঙ্গী। দুটি প্রজাতির মানুষের মধ্যে চোরা স্রোতের শীতল যুদ্ধও চলে সময়ে অসময়ে। কেন? উত্তর জানতে হলে এই বিষয়টির নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণার প্রয়োজন। আজকাল যে অনলাইন সার্ভে বা জনমত জানার চেষ্টা করা হয় সে রকম তাৎক্ষণিক গবেষণার প্রয়োজন। ঘটি-বাঙালিদের মধ্যে  রেষারেষি ও উদ্দীপনা তুঙ্গে ওঠে যখন মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়,যেমনটি শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায়।এখানে কে জয়ী বা কেই পরাজিত আলোচ্য বিষয় নয়। বলার অপেক্ষা থাকে না, সকলেই নিজ নিজ অহং পরিতুষ্ট করতে ব্যস্ত অর্থাৎ এককথায় একে অপরকে ছোট দেখানোর নির্লজ্জ প্রচেষ্টা।

উপরোক্ত বিষয়ে আমাকেও এরকম একধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রায় দুই যুগ আগের ঘটনা, কলকাতার কলেজ পাড়ার ছাত্রাবাসে থাকাকালীন সময়ের। ঘটি-বাঙালি নিয়ে সে মজাদার রসবোধের গল্প প্রায় দুই যুগ পার হওয়ার পরও এখনও একেবারে টাটকা, তরতাজা।  গল্পের নায়ক আমার এক বাংলাদেশি সহপাঠী ও ভুক্তভোগী আমি। কে বাঙাল আর কে ঘটি বলার অপেক্ষা রাখে না।  এক বিশেষ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার দোস্ত বলে সম্বোধন করা আমার খুবই ভালো লাগতো, মনে হতো যেন আপন কেউ। খস করে দু আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরানোর মধ্যে যে কত আনন্দ তাকে না দেখলে বোঝা যেত না, তার একটা মূদ্রাদোষ ছিল  কথায় কথায় ডলারের উপমা দেওয়া। ফরেনারের(বিদেশি নাগরিক) বলে প্রায়শঃ আমাকে  খোটা দেওয়া তার রোজ নামচা ছিল, আর কেনই বা দেবে না, আমার ভাগ্যে নেপাল ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ জোটেনি আর সেখানে যেতে তো কোনও পাসপোর্ট, ভিসা লাগে না, ফলে ফরেনারে হিসেবে কি ভাবে গর্বিত হতে হয় সেটা আমার জানা  ছিলো না।  মাঝে মাঝেই সে শোনাতো জানিস দোস্ত!! আজকে ডলারের মানি অর্ডার পেলাম, হ্যাঁ আমাদের যুগে মানি অর্ডার হতো, কিন্তু পোস্ট অফিসের বুড়ো পোস্টমানটি তো প্রতি মাসেই খস খস করে টাকা গুনে দিয়ে যায়, কই ডলার তো দিতে দেখিনি, কিন্তু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করিনি নচেৎ সকাল সন্ধ্যার বিনামূল্যে চা খাওয়াটা বন্ধ হয়ে যেতে পারতো আমার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশি ফরেনারে বন্ধুর পকেট থেকে। 

হোস্টেলে থাকাকালীনই আমি আমার নতুন পরিচয় সম্পর্কে অবগত হলাম--- "ঘটি"। ঘটিরা নাকি অনেক কৃপণ প্রজাতির প্রাণী ও আরও বহু এধরণের অসম্মানজনক কথাবার্তা প্রায়ই হজম করতে হতো, কিন্তু তীর কি আমার দিকে  ছুড়তো সেটা হলফ করে বলতে পারবো না, অবিশ্যি সে সব মজার ছলেই শুনতাম। তারও বাধ্যবাধকতা  ছিল সকাল সন্ধ্যা চা ফ্রীতে খাওয়ানোর, নইলে নোটস কি ভাবে পাবে? পড়াশুনায় সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভরশীল ছিল। কাকিতলীয় বিষয় এই যে আমার এক সম্পর্কিত মামা, দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে যান, অনেকেই যেমনটি ওদেশ থেকে এদেশে এসেছেন। সেই মামার সাথে কোনোদিনই সাক্ষাৎ হয়নি, হলে জিগ্যেস করতাম, তিনি এখন ঘটি না বাঙাল, সেখানেও কি এই বিষয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করা বাকবিতন্ডা হয়!!

একদিন সন্ধ্যায় বিনামূল্যের চা পান শেষে ক্যান্টিনের বাহিরের ঘাসের উপর বসে ঘটি ও বাঙাল নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছিলো। বিতর্ক মাঝপথে থামিয়ে বন্ধু বলল, শোন দোস্ত! তোকে একটা গল্প শোনায়। আমি মনে মনে খুশি হলাম। শঙ্কিতও ছিলাম কি জানি আবার গল্পের ছলে পরোক্ষভাবে আমাকে অপমানের বড়ি হজম না করতে হয়।

যাই হোক গল্পের কথায় আসা যাক, এই গল্পের নায়ক বন্ধুর পিতা। ঘটনাটি প্রায় আরও বছর পাঁচেক আগের, পরিবারের এক সদস্যকে নিয়ে তিনি কলকাতা এসেছিলেন চিকিৎসা কারণে । তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর শ্যালক কলকাতাবাসী, কাকতলীয় ভাবে তিনি "ঘটি"। ‌শ্যালক মহোদয়, সৌজন্য বোধ ও চক্ষু-লজ্জার ভয়ে  গল্পের নায়ক মানে বন্ধুর পিতাকে তাঁর বাসায় লাঞ্চের জন্য নিমন্ত্রণ জানান। ‌

বলাইবহুল্য, বন্ধুর পিতাও বন্ধুর মতোই ঘটিদের প্রতি সম-ধারণা পোষণ করিতেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে একটু দেরি করেই পৌঁছলেন, গৃহকর্তা আপ্যায়ন করে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন, বসার ঘর থেকে ডাইনিং টেবিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, পাশেই রান্না ঘর  টেবিলে রান্নার পদের কোনও দেখা মিললো না। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করার পর, গৃহকর্তা যথেষ্ট আগ্রহের সাথে খাওয়ার জন্য ডাকলেন ওদিকে পিতার মনের মধ্যে দ্বন্ধ চলছে কি জানি কি খেতে দেয়, ঘটিরা যা কৃপণ প্রজাতির প্রাণী!!

শুরুতেই, বেগুন ভাজি ও ডাল পরিবেশন করা হলো। আগুন্তুকরা একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। ইশারা ইঙ্গিতে যেন বন্ধুকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন "আমি যা সন্দেহ করছি আপনিও কি?" দু জনের মনে সে একই সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল। যাক কোনো রকমের বাক্যব্যায় না করে বেগুন ভাজি ও ডালে মনোনিবেশ করলেন।

গৃহকর্তা বিনম্র হয়ে বললেন দাদা সবটাই শেষ করতে হবে কিন্তু!!

আর কিছু আসবে না নাকি? অগত্যা বেগুন ভাজি ও ডাল দিয়েই গপাগপ গোগ্রাসে ভাত খেতে মনোনিবেশ করলেন।

কিছুক্ষণ পরে একটা করে ডিম সামনে রাখা হলো,  ডিমের বেলায়ও একই কথা। ‌কি আর করা যায়?

তারপর, সামান্য একটু দেরিতে সকল সন্দেহ নিরসন করে একে একে সরষে বাটা ইলিশ, মুরগির রোস্ট, আলুর দম ও আরো কয়েক কিসিমের ব্যঞ্জন ডাইনিং টেবিলে জমা হতে লাগলো। শেষে জিলিপি, সন্দেশ তো আছেই। ‌দুজনের মনেই তখন  আফসোস!!, বেগুন ভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে পেট ভরে কি বোকামিই না করেছে।

এই ঘটনার পর পিতাজী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন পরবর্তীতে কলকাতায় কারোও বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে এ ধরনের ভুল আর কখনোই করবেন না। জামাই না হয়েও, সেখানে জামাই আদর পাওয়া গেছে এই কলকাতায় ভাবা যায়!!

আমি হ্যাঁ করে গল্পটা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এসব উদ্ভট প্রশ্ন এবং চিন্তা ভাবনার উৎস, চিরন্তন ঘটি-বাংলা নিয়ে পরস্পরকে রসিকতা করা থেকে বহু মুখরোচক কাহিনী ইতি উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

আপনাদেরও হয়তো কৌতুহল থাকতে পারে, যাদের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন তারা ঘটি না বাঙাল? না ফিফটি ফিফটি। ভূপেন হাজারিকার একটা কথা মনে পড়ে গেল ….মিলে মিশে একাকার। এইরকম সাঁত পাঁচ ভাবছিলাম।

কি রে দোস্ত কোথায় হারিয়ে গেলি। তৎক্ষণাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম, বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আপনা আপনি একটা যুদ্ধ জয়ী চমৎকার কুটিল হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, ঘটিরা মহা কৃপণ কথাটা হয়তো আর শুনতে হবে না।

কিন্তু পরক্ষণে দেখলাম বন্ধুর মুখে ক্রুর ও তাচ্ছিল্যের হাসি। মনে মনে প্রমোদ গুনলাম, মনে হচ্ছিলো সে আরও বিশদ তথ্য দিতে চায়, যা এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারি নি।

আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু বুঝলি?

এতে আবার কি বুঝার আছে, সবই তো প্রতিবিম্বের মতো স্বচ্ছ। ঘটিদের সম্পর্কে তোর বা তোদের সব ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত।

তুই কিছুই বুঝিস নি দোস্ত- কর্তা ঘটি  হলেও ভাড়ারের চাবিকাঠি ছিল গিন্নির আঁচলে,  তিনি আসলে বাঙাল।

কিছু বুঝলি!!!!!! বন্ধু অট্টহাসি তে ফেটে পড়লো।

আমি নির্বাক......বাকরুদ্ধ, সবকিছুই ক্ষনিকে ভূপাতিত,  বইয়ের পাতাগুলো আনমনে পাল্টালে লাগলাম ........ আর কতক্ষণ সেটা না বলাই ভালো!!

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !