ছোটগল্প-ফিরে দেখা
কলমে : এম ওয়াসিক আলি
কবীরের বদ অভ্যাসটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এইতো গতকালই সাত সকালে পাড়ার এক কাকিমা আকাশবাণীর সম্প্রসারণের মত শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে অপ্রিয় মন্তব্যটা সার্বজনীন করে ফেললেন। গা সওয়া হয়ে গেছে, যে যাই বলুক না কিই বা যায় আসে। ইগনোর কবীর ইগনোর....বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।
প্রতিদিনের মতোই আজও সকালে বাইকটাকে খুব মনোযোগ সহকারে ধোয়ামোছা করছিল, নিজে আশ্চর্য হয় না, নিজ কর্মকাণ্ড দেখে বরং না করলেই মনে হয় কিছু যেন ছুটে গেছে, সারাটাদিন মনটা খচ খচ করে। সত্যি সত্যিই কাজটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাইকের পেছনের সিটটা একটু বেশি সময় নিয়ে যত্নসহকারে পরিষ্কার করে।
এই যে মশায় রোজ রোজ এত পরিষ্কার করার কি আছে? আর কোনও কাজ কর্ম নেই নাকি? চাইলে তো খই ভাজতে পারেন, দু পয়সা পকেটে ঢুকবে......সেই পরিচিত আওয়াজ, খুবই পরিচিত, কিন্তু কোথা থেকে আসে তার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কানে বাজে..কোকিলের কুহু কুহু সুরে।।
এই যে মশায় কথাগুলো কানে ঢুকছে না নাকি!! পুনরায় এদিক ওদিক ঘুরে দেখে কেউ কোত্থাও নেই,... আশ্চর্য!!
সকালের এই মহানতম কার্যটি করার সময় এই ধরনের কথাবার্তা নিত্য তার কানে বাজে, অন্যান্য দিনের মতোই আজও বিড়বিড় করে উঠলো....তুমিই তো ধুলো একদমই পছন্দ কর না, বাইকে করে যতবার তোমায় বাইরে নিয়ে গেছি, ততবার সিটের ধুলো নিয়ে তোমার অভিযোগ ছিল, তাইতো ভালো করে পরিষ্কার করছি।
আচ্ছা এখনো কি ধুলো তোমার অপছন্দের?
হ্যাঁ....
বেশ.. বেশ! করো....আরও ভালো করে পরিষ্কার করো, দেখো এক কণাও যেন ধুলো বালি না থাকে..... খিল খিল করে হাসিটা ক্রমে ক্রমেই মিলিয়ে যায়।
হঠাৎই মোবাইলটা বেজে উঠল, স্ক্রিনে ভেসে উঠল সেই চেনা নম্বরটা........। কবীরের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল বেশ কয়েকগুণ। সে প্রমোদ গুনল, হৃৎস্পন্দন বাড়ার কারণ ফোনের ভাইব্রেশন না, স্ক্রিনে ভাসতে থাকা নম্বরটা। কবীর খুবই সন্তপর্নে ফোনটা রিসিভ করল।
ওপার থেকে পরিচিত কণ্ঠে ভেসে এল, --কেমন আছো?
কবীর কণ্ঠটা প্রায় ২ বছর ৫ মাস ১৭ দিন পর শুনলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, সত্যি সত্যিই সেই পরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসতে পারে। এতো দিন মিথ্যে মিথ্যে কানে বাজতো, সেও বিড়বিড় করতো, সে নিয়ে কতই না হাসাহাসি, ঠাট্টা ইয়ার্কি তার ইয়াত্তা নেই। বাড়িতেও কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। পাড়া প্রতিবেশী রা নিশ্চিত, কবীর পাগল হয়ে গেছে...নইলে কেউ সময়ে অসময়ে এমন বিড়বিড় করে!!
ভালো!!!! কবীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
যেন মুখ দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছে না। নি:শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। শব্দ গুলো যেন মুখগহ্বরের ভিতর হারিয়ে গেছে অথচ একদা এই নম্বরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ননস্টপ হাজারো গল্প করত। হাসি মজাক, খুনসুঁটি চলতো।
ওপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছ ?’
বাইকের সিটের ধুলো পরিষ্কার করছি।
বাইকের সিটটা এখনো পরিষ্কার করো কেন?
কবীর শুকনো হেসে বললো, ‘পুরোনো অভ্যাস।’
তারপর, এদিক ওদিকের আরও কয়েকটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, কবীর সবগুলোরই মাপা মাপা উত্তর দিল, কিন্তু নিজে থেকে কোনও ধরনের প্রশ্ন করলো না।
কিন্তু কবীরের জানতে খুব ইচ্ছে করছিলো এত দিন পর ফোন করার কারণ!! ইচ্ছে করছিল জানতে নতুন ঘর, পরিবার সম্পর্কে জানতে। সে কেমন সুখে আছে!!
কিন্তু কোন প্রশ্নই করা হলো না। মনে মনে ভাবলো কিছু প্রশ্ন বুকের মাঝে সুপ্ত থাকাই ভালো।
ফোনটা পাশে রেখেই কাজে মনোনিবেশ করলো।
হ্যালো হ্যালো........কথা বলছো না কেন?
হ্যালো...........।