জন্মদিন

এডমিন
2

জন্মদিন

কলমে- এম ওয়াসিক আলি
******""""**************


আজ ১২ অক্টোবর, একটা সাধারণ দিন অন্যান্য দিনের মতোই। আজকের দিনটির কোনও বিশেষত্ব নেই সব কিছুই অতি সাধারণ।  দুষ্ট-মিষ্টি সকালের বাতাস গায়ে মৃদু স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে  বেশ ভালই লাগছে, সর্বাঙ্গে শিরশিরে অনুভুতি।  সূর্য্য যথারীতি পুবের দিশাতেই জেগে উঠেছে। পাশের বাড়িতে গোয়ালার কলিং বেলের শব্দ কানে বাজলো, কিছু পরেই অন্যান্য দিনের মতো রোল করা দৈনিক খবরের কাগজটি পেপারম্যান দরজায় ছুড়ে ফেললো। ঠিক এর পরেই চায়ের জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে লাগলো, ঠিক অন্যান্য পাঁচটা দিনের মতোই। হাতে খবরের কাগজ ও চায়ে চুমুক দিতে দিতে সামনের বাড়ির বাচ্চা দুটোর স্কুলে যাওয়ার তোরজোড়, এটা কোথায়, ওটা কোথায় নিয়ে নিত্য দিনের এক ঘেঁয়েমি ঝগড়া সব কিছুই নিয়মমাফিক চলছিল, কোত্থাও কোন নতুনত্ব নেই।  একটা নিরস দিনের সূচনা যে ভাবে হয়, আরও একটা বিরক্তিকর দিন।

আজ সাকিবের জন্মদিন, পুরো নাম মোহাম্মদ সাকিব আহমেদ।

সাকিবের জীবনের অনেক স্মৃতিই তার মস্তিস্ক থেকে লোপাট হয়ে গেছে কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি,কিছুতেই স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলা যায় না। ঠিক তেমনই কিছু কিছু শব্দ ভোলা যায় না,  যেমন "জন্মদিন" শব্দটা।

আজ সাকিবের জন্মদিন। সাকিব নিজের জন্মদিনটা কখনোই ভুলতে পারে না। ছোট্টবেলার কথা আবছা আবছা অল্প-বিস্তর মনে পড়ে, এক অজ পাড়াগ্রামে তাদের কাঁচাপাকা মাটির বাড়ি ছিলো, আব্বু গ্রামেরই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন ও মা গৃহকর্তী, বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা গোয়াল ঘর ছিল, সেখানে দুটি গায়বাঁধা থাকতো সাথে দুটি তিড়িং বিড়িং করে লাফানো ধপধপে সাদা দুটি বাছুর, দুটি চাষের বলদ, হাঁস মুরগির খুল্লা, কার্নিশে ঝোলানো পায়রার ঘুপচি ঘর ও আরও অনেক কিছুই যেগুলো গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্তের ঘরে থাকার কথা সব কিছুই ছিল। আর ছিল একটা 5'x3' ফুটের ধান সিদ্ধ করার চৌবাচ্চা, সেটার পাশে ছিলো একটা টিউবওয়েল। যখন- তখন হ্যান্ডেলে ঝুলে পড়ত আর জল বেরোতো, খুব মজা লাগতো, সেই জল বালতিতে জমিয়ে, মগ দিয়ে একটু একটু করে চৌবাচ্চাতে ঢালতো, এই অপকর্মের জন্য ধরা পড়লেই দাদু আর আব্বুর হাতের চড়ও হজম করতে হয়েছে। আরও একটা বিশেষ জিনিস ছিল যারে একেবারেই ভোলা যায় না সেটি হল বারান্দার উপরের চৌকাঠ, সেখানে নিপূণ হাতে খোদাই করা ছিল " এই বাড়ির মালিক মহম্মদ সাকিব আহমেদ, জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯৭৮"। সবেমাত্র যুক্তাক্ষর সহ অ-আ, ক- খ পড়তে শিখেছি, বারান্দায় যখন তখন দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে পুরো লেখাটা অনেক সময় ধরে পড়ার চেষ্টা করতো,  নিজের নাম উচ্চারণ করে সাকিবের খুব মজা লাগতো। তারপর একদিন বাড়িতে অনেক লোকের জমায়েত হল, আব্বু ও আম্মু পাশাপাশি শুয়ে আছে, নাকে গুঁজা সাদা তুলো, অনেকেই কান্নাকাটি করছিল, বিশেষ করে মেয়েরা, তাদের অনেককেই সে চেনে না।  তারপর সাদা কাপড়ে মুড়ে দুটি খাটে শুইয়ে ফুটবল খেলার মাঠের দিকে নিয়ে গেল, পেছনে অনেক লোক। তারপর ঠিকানা মামার বাড়ী। চলন্ত ট্রেনের পেছনে চলে যাওয়া গাছপালাগুলোর মতই সাকিবের শৈশবের দিনগুলো  কোথায় যেন হারিয়ে গেল, মামার বাড়িতে সম্পূর্ন নতুন পরিবেশ, মামীর চোখ গরম করে তাকানো দেখলেই হাড় হিম হয়ে যেত। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলো আববু- আম্মু বিহীন পৃথিবীর আসল চরিত্র।  ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন একদিন মামার হাতে উত্তম মধ্যম খাওয়ার পর রাগে সাকিব মামার ছেলের মাথা ফাটিয়ে মাতুয়ালয় ত্যাগ করে গ্রামের বাড়ীতে ফিরে আসে কিন্তু সে বাড়িতে ঠাই মিললো না। সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ঠিকানা কোলকাতা শহর। একটা ভাতের হোটেলে খাওয়া- থাকার বিনিময়ে সংঘর্ষের হাতেখড়ি। কোলকাতা শহরের হৃদয়টা অনেকই উদার, এখানে এসে কেউ না খেয়ে মরে না, এই শহর অনেকের মতো সাকিবকেও নিরাশ করেনি, আপন করে নিয়েছিল। সাকিবের পড়াশুনার উপর বরাবরই টান একটু বেশীই ছিল। জমানো টাকা দিয়ে  ক্লাস সেভেনের পুরনো বইপত্র কিনে, হাড়-ভাঙা কাজের শেষে, হোটেলে রান্না ঘরের পাশে চিলতে ঘরে শুয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তো। পাড়ার পাকা চুলদাড়িয়ালা এক দাদু প্রতিদিন রাতে সেই হোটেলে খাবার খেতে আসতেন, তার সাথে বেশ ভালই সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল, পড়াশুনার প্রতি সাকিবের ঝোঁক দেখে, সতস্ফুর্ত ভাবে তাকে একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। অবিশ্যি স্কুল যাওয়ার দরকার ছিলো না, শুধু পরীক্ষা দিলেই হত, সেখান থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর সে জয়েন্টে চান্স পেয়ে যায় । পরবর্তীতে সহৃদয় দাদুর আর্থিক সহায়তায় বি-টেক পাশ করে আজ এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত। দাদু ঋণ শোধ করার সুযোগ না দিয়েই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। সাকিব অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন রাতে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে মাঝ আকাশে তারাদের ভিড়ে দাদুকে দেখার চেষ্টা করে, তার মনে হয় দাদুও তার অপেক্ষায় থাকেন এবং দু হাত তুলে আশীর্বাদ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকার পর ঘরে চলে যায়।
বিগত সারাটি রাত এদিক ওদিক করে কেটেছে, যখনই চোখের পাতাজোড়া এক হয়, ঘোরের আচ্ছন্ন হয়ে ভাবতে থাকে আগামীকাল সে কি করবে, কি ভাবে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করাবে, নিজের প্রতিচ্ছবিকে কি উত্তর দেবে!!

আজ সাকিবের জন্মদিন, প্রতিটি মানুষের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন, সকলেই নিজের মত দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করে, ধুম ধাম সহকারে বন্ধুবান্ধবদের সাথে হুই হুল্লোড়, মস্তি চলে। আজকাল আবার জন্মদিনের কেক কাটার ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছে... এমনই আর কতো কি!!!

প্রতি বছর যেমন যেমন জন্মদিনটা এগিয়েআসে, সাকিবের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে থাকে, মনের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যায়। হোস্টেলে থাকাকালীন বন্ধুরা একবার চেষ্টা করে ছিল বাকি বন্ধুদের মত খুব ধুমধাম করে তার জন্মদিনটা পালন করার, আগেভাগে জানতে পেরে সেই রাতে হোস্টেলেই ফিরে আসেনি, সারাটাদিন গড়ের মাঠ ও রাত স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল ফিরেছিল।

তার মনে হয়, সে জন্ম গ্রহণ করে কোন মহান কার্য করেনি, যে কারণে অযথা হৈ-হুল্লোর করে দিনটি পালন করতে হবে। বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করবে...। বাকিদের কি ভাবে বোঝাবে, তার মনের গোপন ব্যাথা, এই দিনটিতে তার মনের ঝুলিতে যত দুঃখ কষ্ট জমে আছে সব বেরিয়ে আসে একে একে। একবার দাদু তার জন্মদিন পালন করার জন্য বেশি জোরাজুরি শুরু করেন, সাকিব সেদিন শুকনো হেসে বলেছেন, দাদু যেদিন এমন কিছু অসাধারণ কাজ করে নিজেকে গর্বিত করতে পারবো সেদিন জন্মদিন পালন করবো, আজ না দাদু। একমাত্র দাদুই তার সাকিবের অতীত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন অন্তত একবার তাকে জন্মভিটায় নিয়ে যেতে, কিন্তু সাকিবকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি, বরং তার একগুঁয়ে আচরণে মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবকেও অস্বীকার করার উপায় ছিল না।

অন্যদিন এইসময় অফিস যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে, কিন্তু আজ না শরীর না মন দুটোর কোনোটাই সঙ্গ দিচ্ছে না, সব কাজেই ভুল হচ্ছে।  গ্যাসে দুধ উপচে পড়ে একসা, চায়ে এক চামচ চিনির জায়গায় দুই চামচ চিনি দিয়ে বেশি মিষ্টি করে ফেলেছে, তার অল্প মিষ্টি চা খাওয়ার অভ্যাস, শেষমেশ এক চুমুক দিয়েই বেসিনে ফেলে দিল।

স্নানের জন্য রেডি হচ্ছিল সে সময়েই ফোনের রিং বাজলো, ডিসপ্লেতে হিনার নাম। হিনা ও সাকিবের অফিস একই বিল্ডিংয়ে ঠিক উপর নিচে। বছর খানেক আগে অফিসের কান্টিনে আলাপ এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ভালোলাগার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ একে অপরের মনের কথা জানাতে পারে নি।

সাকিব বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল।
"হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!!" সাকিব।
কার বার্থডে? সাকিব এমন ভাবে উত্তর দিল, যেন আকাশ থেকে পড়ল।
আজ তোমার বার্থডে না?
না তো!!! কে বলেছে তোমাকে।

হিনা ভাবছে, সাকিব নিশ্চিত  তার সাথে দুষ্টুমি করছে, সে হাসতে হাসতে বলল, জনাব আমার কাছে পাক্কা খবর আছে, ১০০% আজ তোমার বার্থডে।

সাকিব সেই একই সুরে বললো কে তোমাকে আল-ফাল তথ্য দিয়েছে, আজ মোটেও আমার বার্থডে নয়। ফোন রেখো অফিসের জন্য রেডি হতে হবে।

হিনা আশ্চর্য হল সাকিবের আচরণে, কেন সে মিথ্যা কথা বলছে, যে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে খবর পেয়েছে কোনও মতে ভূল হতে পারে না। তবে কি তার অফিসের রেকর্ড ও আসল জন্মদিন আলাদা। হতেও পারে...সে মনে মনে বোকার মতো হাসলো।

সত্যি বলছো তো?
হ্যাঁ বাবা সত্যি!!
কিন্তু তোমার অফিসের রেকর্ড বলছে আজকে তোমার বার্থডে!! দেখো আমার সাথে চালাকি করে পার পাবে না।

সাকিব বেশ সুর চড়িয়ে বললো, খেয়ে দেয়ে কাজকর্ম নেই নাকি, না সকাল সকাল গাঁজা খেয়েছো?

হিনা সাকিবের এহেন আচরণে অবাক!! ভাবতেই পারছে না, সে এভাবে রিয়্যাক্ট করবে।

ঠিক আছে নাই বা হলো আজ তোমার বার্থডে, এতো রাগের কি আছে, বলেই হিনা সাকিবকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল।

সাকিব একেবারেই হতভম্ব, ভাবতেই পারেনি হিনা এভাবে ফোন কেটে দেবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রিং ব্যাক করলো, কিন্তু ওপান্তের ফোন সুইচ অফ।  আর এক টেনশন!! নতুন উটকো ঝামেলা।সাকিবের এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। সেই বা কি করবে, তার মনের অবস্থা শোচনীয়!!  কিন্তু বেচারি হিনা সে তো তার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না, যদিও বেশ কয়েকবার কৌতূহলবশত জানতে চেয়েছিল কিন্তু সাকিবের অনাগ্রহ দেখে আর আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু একটা সম্পর্কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা থাকা একান্তই প্রয়োজন।

বেচারা সাকিব, জন্মদিনেই হিনার সাথে দুর্ব্যবহার করে ফেললো এবং নিজের জেদের বশবর্তী হয়েই সে এমন আচরণ করছে। সাকিব অনেকবার চেষ্টা করেছে হিনাকে নিজের সম্পর্কে সব কিছুই খুলে বলতে, কিন্ত বলতে বলতেও আটকে গেছে। অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে বারবার সম্বরণ করেছে ..... ।

এমনই অনেক কথা ভিড় জমায় সাকিবের মনে। না আর কিছুক্ষণ গড়িমসি করলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে, সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে স্নান করতে ঢুকলো।

এদিকে হিনার রাগ একটু কমতেই, ফোনটা নিয়ে নড়াচড়া করতে লাগলো। তার মনের ভিতর দন্ধ চলছিল, বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ফোনটাকে অন করলো, অনেকগুলো মিস কল। মনটা এখন অনেকটাই  শান্ত,  বেশি জলঘোলা না করে রী-ডায়াল করলো, একবার, দুবার এবং পরপর বেশ কয়েকবার, কিন্ত ওপার থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই, তার চিন্তা বাড়তে লাগলো, শেষমেশ এসএমএস পাঠাল"ফোন তুলছো না কেন? প্লীজ একবার কথা বলো। আর কখনও তোমাকে বিরক্ত করবো না, আই অ্যাম রিয়েলি সরি... "

সাকিব বাথরুম থেকেই রিংটোন শুনতে পাচ্ছিল, তড়িঘড়ি কোনমতে স্নান সেরে বাইরে এলো, কল লিস্টে গিয়ে ফোন করার আগেই পুনরায় রিং বাজলো।

হ্যালো, কি হয়েছে তোমার, ফোন তুলছো না কেনো?

সাকিব খুব ঠান্ডা গলায় বললো, আমি বাথরুমে ছিলাম।

হিনা- ও, আমি ভাবছিলাম.......
সাকিব- থাক থাক আর বেশি কিছু ভাবতে হবে না। যদি ভাবতেই, ফোন কেনো অফ করেছিলে?

হিনা- রাগে?
সাকিব- কিসের রাগ?
হিনা- তুমি জানো না?
সাকিব- না!! জানলে কেনো জিজ্ঞেস করবো?

জানি আজ আমি তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছি,  সত্যি বলছি তোমার ব্যবহারে আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম, কি করবো বুঝতে না পেরে রাগে ফোন অফ করে ফেলেছিলাম।

তো.....…...রাগ কমলো? সাকিব একটু মজা নিয়ে বললো।

খুব মজা নিচ্ছ দেখছি!!

নিচ্ছিই .... অস্বীকার করছি না।

থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। শোনো না........ একটা কথা বলি?

হ্যাঁ বলো, কান খোলা আছে, সাকিব নিজেও জানে না, কেন সে হিনার সাথে এমন ব্যবহার করছে। কতবার যে মনের দুঃখ কষ্টগুলো হিনার সাথে ভাগ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। প্রতিবারই অন্তরাত্মার ডাক,তাকে বিরত করেছে। তার মনের ভিতর সব সময় যুদ্ধ চলতে থাকে, এক প্রকারের অন্তর্দহ। কতবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেখেছে, হিনাকে এক ঝটকায় টেনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে, মনের ভিতর জমে থাকা সব দুঃখ কষ্ট গুলো তোতাপাখির মতো গড়গড় করে বলে ফেলেছে।

হ্যালো হ্যালো... ওপার থেকে হিনার ডাকে সম্বিত ফিরে এলো। তুমি কোথায় চলে যাও ফোন ছেড়ে?

কোত্থাও না..!!!

হিনা- একটা কথা বলি, রাখবে তো?

বলো....

তুমি আজ আমার সঙ্গে অফিস যাবে।

তোমার সঙ্গে কেন? তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না, যথাসময়ে পৌঁছে যাবো, সাড়ে দশটায় ক্যান্টিনে দেখা হচ্ছে, ঠিক আছে!!!

কেন যাবে না শুনি?  হিনা কপট  অভিমানের সুরে বললো।

এমনি!! সাকিব বিনা কারণে নিজের সাথে লড়াই করছে, হিনার কোনও ভূল নেই তবুও। শুধুমাএ একটাই কারণ কি, জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে? না তার জীবনে অন্য কেউ ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করছে সে জন্যে?

উত্তর না পেয়ে বেশ  কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থাকার পর হিনা ফোন কেটে দিল।  ফোন কেটে, বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলো, সাকিব কেন এমন আচরণ করছে, আগে তো কখনো এমন ব্যবহার করে নি, সে নিশ্চিৎ কোনও মানসিক চাপে আছে নয়তো পরিবারে কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে। হিনা তার ঘর পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানে না, সাকিব নিজে থেকে কোনও কিছুই জানায় নি এমনকি বেশ কয়েক বার জিজ্ঞাসা করলেও প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে। সে কে? তার পরিবারেই বা কে কে আছে?  কিছুই জানে না। এমন অচেনা অজানা ছেলের সাথে সম্পর্ককে তার পরিবারে কেউ মেনে নেবে না, সেটা হিনা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তূ সাকিবকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না, সেটাও খুব ভালো করেই জানে। হিনা বারবার আগ্রহ সহকারে সাকিবকে কাছে টানার চেষ্টা করছে উল্টে অবুঝ বালকের মতো হেলায় তার পরোক্ষ প্রেম নিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করছে। প্রতিবার অনুনয় বিনয় করার সময় হিনার গলা অবরুদ্ধ হয়ে আসতো, যেন গলাতে কিছু আটকে গেছে।

এমনই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পুনরায় ফোন লাগলো, কিন্তু হ্যালো হ্যালো ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না । অগত্যা রণে ভঙ্গ দিয়ে হিনা পার্স গোছাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ফোন সাকিবের ফোন, দেখে ঝট করে তুললো।

সাকিব খুব শান্ত স্বরে বলল - একটু তাড়াতাড়ি এসো।

হিনার খুশির শেষ নেই, খুশিতে পাগল হয়ে যায় যায় অবস্থা,বিন্দুমাত্র দেরি না করে, স্কুটিটা স্টার্ট করে ঝড়ের বেগে রওনা দিল।

বছর খানেক ধরে হিনার সাথে সম্পর্ক, কিন্তু সাকিব কোনদিনই তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখায়নি, আর পাঁচটা প্রেমিক যুগলের মতো হাতে হাত রেখে হ্যাংলাপনা তার একেবারেই না পছন্দ।  হিনাও খুব চালাক চতুর মেয়ে, সেও কোনও দিন জোরাজুরি করে নি।

হিনা আবার হুট করে না যেন তার ফ্ল্যাটে ঢুকে যায়, এই ভয়ে সাকিব তড়িঘড়ি বেরিয়ে রাস্তার ওপারে মোড়ে দাঁড়িয়ে হিনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মেরুন রঙের স্কুটি এসে পাশে দাড়ালো, হেলমেট খুলতেই সাকিব হিনার দিকে ফ্যাফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, ফোলা ফোলা লাল চোখ, মেয়েরা যে নূন্যতম প্রসাধন করে সেটাও করে নি, মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে, খোঁচা খোঁচা আই ভ্রু,  প্লাক করা হয়নি ফলে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তার মুখমণ্ডলের আকর্ষণীয় জেল্লা হারিয়ে গেছে, আহা.....বেচারি যেন বিরহের আগুনে ঝলসে গেছে। সাকিবের খুব মায়া হলো হিনার অবস্থা দেখে, তার হৃদয় করুণা ও গ্লানিতে ভরে উঠলো, নিজের অপকর্মের জন্য মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানালো।

প্রবাক্য আছে চিতা কখনোই নিজের শরীরে চোটের আঁচড় কখনোই রাখে না, ঠিক সে রকমই হিনা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না রেখে, মুখমণ্ডলে মিথ্যার কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। স্কুটির পেছনের সিটে সরে গেল আর সামনের  দিকে ইশারা করে বললো- "চলো. এতটুকু শব্দের মধ্যে যতোটা মিষ্টি ও কোমলতা মিশিয়ে উচ্চারণ করা যায়, সেভাবেই বললো।

খুব রাগ হয়েছে বুঝি? কথাগুলো বলার সময় সাকিব হিনার চোখে চোখ মেলতে পারলো না।

হিনা নিজের কষ্ট যথাসম্ভব দমিয়ে রেখে বললো-- না তো!!!!!

ঠিক করে কথা বলছো না কেন?

হিনা এবার সাকিবের চোখে চোখ রেখে বললো- সব সময় বেহায়ার মতন হেহেহেহে করতে হবে নাকি?

না মানে..... মনে হচ্ছে তুমি খুব রেগে আছো!!!

থাক!! আর জাস্টিফিকেশন দিতে হবে না।হিনা যথারীতি শান্ত সুরে বললো - একটা কথা বলি রাখবে তো?

সাকিব নিরুত্তর.......! তার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই বললো কিছু ক্ষণের জন্য ফ্ল্যাটে চলো না।

তবে কি আমরা অফিস যাচ্ছি না? অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে, খুব জরুরী কাজ পড়েছে।

প্লিজ..... কয়েক মিনিটের জন্য!!!!

তোমার সবকিছুতেই জেদ!! চুপচাপ অফিস চলো নইলে আমি আর দেরি করতে পারবো না, একাই চলে যেতে বাধ্য হবো, বলেই সাকিব সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

হিনা ঝট করে সাকিবের বাম হাতের  কব্জি ধরে ফেললো।

দেখো রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করো না।

হিনার দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সাকিব প্রথমবার হিনার চোখে জল দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। মুখে কোনও শব্দ উচ্চারণ না করেই ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

ফ্ল্যাটে ঢুকে, হিনা পার্স থেকে সুন্দর রঙিন রাপারে মোড়া ছোট্ট একটা গিফট বের করে সাকিবের দিকে তাকালো এবং সামান্য একটু শুকনো মৃদু হেসে বললো - তোমার জন্মদিন ভেবে কিনেছিলাম।

"সরি!! এই উপহার নিতে পারবো না, আর হ্যাঁ তুমি কেন বুঝতে পারছো না, কতবার বলবো আজ আমার জন্মদিন না। যেখান থেকে কিনেছো ফেরত দিয়ে নিজের জন্য অন্য কিছু কিনে নাও।" সাকিব কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ফেললো।

দেখো তোমার আচরণে আমি আজ অনেক দুঃখী, তুমি আমার সাথে কেন এমন ব্যবহার করছো? কিছুতেই বুঝতে পারছি না, সকাল থেকে ভেবে ভেবে মরছি, কিন্তু কিছুতেই নিজের ভূল ধরতে পারছি না। এতো কষ্ট দিচ্ছ কেন?প্লিজ আর কষ্ট দিও না, তোমার জন্মদিন ভেবে গত ১০-১২ দিন ধরে কতই না স্বপ্নের জাল বুনেছি, তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। আজকের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে কতই না প্ল্যানিং করেছি। তুমি মনে হয় ঠিকমত আমার চোখের দিকে চেয়ে দেখনি, খুব ভালো করে জানো আমি কাজল লাগাতে একদম পছন্দ করি না, আজ শুধু তোমার জন্য কাজল লাগিয়েছি।

চকিতে সাকিব হিনারা চোখের দিকে তাকালো, সত্যিই তো সে লক্ষ্যই করেনি। কাজল লাগানো তার চোখ দুটো এতো সুন্দর , না বললে সে কিছুতেই বুঝতে পারতো না। কিছুক্ষণ আগে দূর থেকে ফোলা ফোলা লাল চোখ দুটো দেখেছিল।

কথাগুলো বলার পরপরই হিনার ধর্য্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙে যায়, ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে শুরু করে,  অবিরাম ঝরে পড়া অশ্রু জলে,  পরিপাটি করে লাগানো কাজল ধুয়ে মুছে গাল বরাবর নেমে আসতে লাগলো।

সাকিবের ক্রমাগত নিজের সাথে লড়াই করে ক্লান্ত, তার অন্তরাত্মা যেন তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। অপরাধ বোধের গ্লানিতে, তার হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে, নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। কতবার সে হিনাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে নিজের সমস্ত দুঃখ কষ্ট গুলো তার সাথে শেয়ার করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।

আজ আর পারলো না।ঝট করে বুক সেল্ফ থেকে একটা ড্রয়িং বুক বের করে হিনার হাতে তুলে দিল ও কান্না থামাতে ছুটে বাথরুমে ঢুকে গেল।

হিনা অবাক হয়ে বাথরুমের দরজার দিকে চেয়ে রইল। আশ্চর্য সহকারে প্রথম পাতা থেকে একএক করে ড্রয়িংগুলো মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো, ঠিক কতক্ষণ ধরে দেখেছে কিছুই খেয়াল নেই, সাকিব কখন যে বাথরুম থেকে ফিরে এসে তার সামনে দাড়িয়ে আছে সে খেয়ালও নেই। ড্রয়িং বুক দেখা শেষে তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না, সাকিবের জীবনকাহিনী ড্রয়িং বুকে শুরু থেকে এখন অব্দি নিখুঁত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সাকিবের অতীত ও বর্তমান এখন জলের মতো স্বচ্ছ, গ্রামের বাড়ীর চৌকাঠে লেখা তার জন্মদিন, চৌবাচ্চা, ছোটবেলায় জীবন যাপন,  আব্বু-আম্মুর মৃত্যু, মামা বাড়ীর চিত্র, কোলকাতা শহরে বেচেঁ থাকার প্রতিটি ক্ষণের লড়াইয়ের ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা নিখুঁত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

হিনা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়ে সাকিবকে জড়িয়ে ধরলো, তার বুকে মুখ গুঁজে কতক্ষণ কেঁদেছিল তার ইয়াত্তা নেই। সাকিবের চোখের বড় বড় ফোঁটা টপ টপ করে ঝরে হিনার চুল ভিজতে শুরু হয়েছে। তারা যে একে অপরের পরিপূরক, উভয়েই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।

দুজনের চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু মিলে মিশে একাকার। গঙ্গা যমুনার মিলনের পর জল যেভাবে  এক হয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই তাদের দুটি হৃদয় মিলে একাকার। দুটি হৃদয় এক প্রাণ- "সাকিহিনা"।

সাকিব তার মুখখানি হিনার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বললো- " আজই আমার জন্মদিন পাগলী!!"


*****

Post a Comment

2Comments
  1. অসাধারন গল্প। খুব ভালো লাগলো 👍🏻👍🏻

    ReplyDelete
  2. অসাধারন গল্প। খুব ভালো লাগলো ��������

    ReplyDelete
Post a Comment

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !